শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১২:৪৪ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু বছর আগে অত্যন্ত আক্ষেপের সঙ্গে লিখেছিলেন ‘সাত কোটি বাঙালীরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি’। কবি নিশ্চয় তার জীবদ্দশায় বাঙালির এমন কিছু ত্রুটি দেখেছিলেন যা মানবিক গুণ সম্পন্ন নয় এবং পরিবর্তন যোগ্য নয় বলেই এ মন্তব্য করে গেছেন। যে কলঙ্ক আজও আমরা মুছতে পারিনি।
আমাদের চারপাশে উৎপাতের অন্ত নেই। বাড়ি থেকে কর্মস্থল পর্যন্ত সর্বত্রই উৎপাত। অনেক সময় ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করেও উৎপাত থেকে রেহাই মেলে না। কখনও প্রতিবেশীর দ্বারা, পথচারী দ্বারা এমনকি বাড়ি মালিক বা ভাড়াটিয়া দ্বারা। আমরা যেন উৎপাতের রাজ্যে বাস করছি। কিন্তু এ উৎপাত প্রতিরোধে রয়েছে আইন। এবার জেনে নেয়া যাক উৎপাত প্রতিরোধে এ আইন কিভাবে প্রয়োগ করা যায়।
উৎপাত শব্দের অভিধানিক অর্থ অর্থ হচ্ছে উপদ্রব, দৌরাত্ম্য, অত্যাচার। এটি এমন এক ধরনের অপরাধমূলক কাজ, যা জনগণের অধিকারে হস্তক্ষেপ করে। আরও সহজ করে বলতে গেলে অন্যের ভোগে বা স্বাচ্ছন্দ্যে ব্যাঘাত ঘটানোর নামই উৎপাত। এটি দেওয়ানী ও ফৌজদারী অপরাধ। গণ-উৎপাত সম্পর্কে আমাদের ১৮৬০ সালের দ-বিধির ২৬৮ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি কর্তৃক জনসম্মুখে এমন কোনো কাজ করা, যার দ্বারা জনগণের বিরক্তি সৃষ্টি হয় এমন কার্য করাকে গণ উৎপাত বলে’। লাইসেন্সপ্রাপ্ত হয়ে আইনানুগ ব্যবসা করতে গিয়ে যদি জনসাধারণের শারিরীক অস্বস্তিকর শব্দ বা গোলমাল সৃষ্টি করে তা গণ-উপদ্রব বলে গণ্য হবে। (পিএলডি ১৯৬৮, ৮২৩)।
আর দ-বিধির ২৯০ ধারায় এর শাস্তি সম্পর্কে ২০০ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার কথা বলা হয়েছে। আজ থেকে প্রায় ১৬০ বছর আগে প্রণীত দ-বিধির শাস্তি হিসেবে ২০০ টাকা যদিও বর্তমান বাস্তবতায় খুবই সামান্য, তবু শাস্তি শাস্তি হিসেবেই গণ্য হয়। দ-বিধির সংজ্ঞা অনুযায়ী, যেকোনো ব্যক্তি তার অবৈধ কাজ যা জনসাধারণের উপদ্রব সৃষ্টির জন্য দায়ী, যা জনসাধারণের শারীরিক বা মানসিক আঘাত, বিপদ বা বিরক্তি সৃষ্টি করে। অতএব, কোনো ব্যক্তির উচ্চ শব্দের সংগীতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা বৈধ অধিকার, যা শব্দের তীব্রতার কারণে একটি অপরাধকে গঠন করে। কোন স্থানে ফ্যাক্টরী স্থাপিত হয়। ওই স্থানে জনবসতি বেড়ে যায়। ফলে ফ্যাক্টরী জনসাধারণের উপদ্র্রব ঘটাতে থাকে। এমতাবস্থায় তা গণ উপদ্র্রব বলে গণ্য হবে। (এআইআর ১৯৫৮, পাঞ্জাব, ১১)। যে ব্যক্তি নিজের ঘরকে জুয়াড়ীদের আড্ডাতে পরিণত হতে দেয় কিংবা জনসাধারণের রাস্তার অংশবিশেষের উপর যিনি ইমারত বানান কিংবা রাস্তার উপর পশু জবাই করেন কিংবা জনসাধারণের ব্যবহার্য স্থানে প্র¯্রাব করেন তাহলে উক্তরুপ কাজে সকলেই গন উপদ্রব সৃষ্টি করেছেন বলে গণ্য হবে। এ কাজগুলি বন্ধে উপযুক্ত ব্যক্তি কর্তৃক নির্দেশ জাারি করার পরও অব্যহত থাকে, তাহলে দায়ী ব্যক্তি দ-বিধির ২৯১ ধারা মোতাবেক বিনাশ্রম কারাদন্ড যার মেয়াদ ছয় মাস পর্যন্ত হতে পারে বা অর্থদন্ডে বা উভয়বিধ দন্ডে দন্ডিত হবে।
আমাদের দ-বিধি আইনের ২৯৪ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি, অন্যদের বিরক্তি সৃষ্টি করিয়া (ক) কোন প্রকাশ্য স্থানে কোন অশ্লীল কার্য করে অথবা (খ) কোন প্রকাশ্য স্থানে বা সন্নিকটে কোন অশ্লীল গান, গাঁথা সঙ্গীত বা পদাবলী গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে; সেই ব্যক্তি যে কোন বর্ণনায় কারাদ-ে যাহার মেয়াদ ৩ মাস পর্যন্ত হইতে পারে বা অর্থদ-ে বা উভয়দ-ে দ-নীয় হবে।’
দ-বিধি আইনের ৫০৯ ধারা অনুযায়ী, ‘যে ব্যক্তি কোন নারীর শালীনতার অমর্যাদা করার অভিপ্রায়ে এই উদ্দেশ্যে কোন মন্তব্য করে, কোন শব্দ বা অঙ্গভঙ্গি করে বা কোন বস্তু প্রদর্শন করে যে উক্ত নারী অনুরূপ মন্তব্য বা শব্দ শুনতে পায় অথবা অনুরূপ অঙ্গভঙ্গি বা বস্তু দেখতে পায়, কিংবা উক্ত নারীর নির্জনবাসে অনধিকার প্রবেশ করে, সেই ব্যক্তি ১ বৎসর পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদ- বা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন।’
কাজেই ভিক্ষুকের উৎপাত, হিজড়াদের উৎপাত, মাদকসেবীদের উৎপাত, যানবাহনে উচ্চমাত্রার হর্ন ব্যবহার করে শব্দদূষণের উৎপাত, বায়ুদূষণের উৎপাতসহ পরিবেশ দূষণজনিত উৎপাত, ভাসমান পতিতাদের উৎপাত, ময়লা-আবর্জনা-ধোঁয়া-দুর্গন্ধজনিত উৎপাত, হৈ-হুল্লোড়জনিত উৎপাত, চলাচলজনিত উৎপাত, উচ্চস্বরে মাইক বা ঢাকঢোল বাজিয়ে বা সাউন্ডবক্সে গান-বাজনা বাজিয়ে বা রাতের বেলায় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে মাইক ব্যবহার করে উৎপাত সৃষ্টি করাপূর্বক লেখাপড়া ও ঘুমে বিঘœ ঘটানোর উৎপাত, স্কুল-কলেজ আর রাস্তার মোড়সহ যেখানে-সেখানে বখাটেদের উৎপাত, আড্ডাবাজদের উৎপাত, হকারদের উৎপাত, পথে-ঘাটে চলাচলের সময় উৎপাতসহ নানা ধরনের উৎপাত উপরোক্ত দন্ডবিধিসমূহের আওতায় পড়বে।
উৎপাত আর কর্তব্য অবহেলা এক নয়। কেউ ক্রমাগত উৎপাত করলেও বিষয়টিকে আমরা অবহেলা বা অজ্ঞতা বলে ক্ষমার চোখে দেখি। ফলে উৎপাতের পরিমাণ বাড়ে বৈ কমে না। সম্ভাব্য ও অনুমেয় ক্ষতির জন্য সাবধানতা অবলম্বনে কেই ব্যর্থ হলে বিষয়টিকে আমরা অবহেলা বলে গণ্য করতে পারি। কিন্তু উৎপাত নয়। কেউ তার এ কাজের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হলে তাকে আমরা অবহেলার দায়ে দায়ি করতে পারি।
কেউ হুমকি দিলে, বিরক্ত করলে কিংবা শান্তি বিনষ্ট হলে ফৌজদারী কার্যবিধি আইনের ১০৭/১১৭ (সি) ধারায় মামলা রুজু করে প্রতিপক্ষকে শান্তিশৃঙ্খলার বন্ধনে আবদ্ধ করা হয়। এক কথায় ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ কিংবা স্বার্থ উদ্ধারের জন্য আমরা একে অপরকে ভয়ভীতি কিংবা হুমকি প্রদর্শণ করে থাকি। এ ধরণের কর্মকান্ড থেকে কাউকে নিবৃত করার ক্ষেত্রে ১০৭ ধারা একটি বলিষ্ট হাতিয়ার। তবে এ ধারার মামলা একটি জামিনযোগ্য অপরাধ। অপরাধীকে মুচলেকার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তির জীবনের নিরাপত্তা বিধান করতেই এ ধারাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৬ ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কেউ কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে বা সেখান হতে দৃষ্টিগোচরে স্বেচ্ছায় এবং অশালীনভাবে নিজদেহ এমনভাবে প্রদর্শন করে যা কোন গৃহ বা দালানের ভিতর থেকে হোক বা না হোক কোন মহিলা দেখতে পায় বা স্বেচ্ছায় কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোন নারীকে পীড়ন করে বা তার পথ রোধ করে বা কোন রাস্তায় বা সাধারণের ব্যবহার্য স্থানে কোন অশালীন ভাষা ব্যবহার করে, অশ্লীল আওয়াজ, অঙ্গভঙ্গি বা মন্তব্য করে কোন মহিলাকে অপমান বা বিরক্ত করে তবে সেই ব্যক্তি ১ বৎসর পর্যন্ত মেয়াদের কারাদ-ে অথবা ২ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দ-ে দ-িত হবেন। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অধ্যাদেশের ৭৫ ধারায় ‘সর্ব সমাজে অশালীন বা উচ্ছৃঙ্খল আচরণের শাস্তি হিসেবে তিন মাস মেয়াদ পর্যন্ত কারাদ- বা ৫০০ শত টাকা জরিমানা বা উভয়দ-’ শাস্তির বিধান আছে। যার জন্য একজন অপরাধীর জেল-জরিমানা হতে পারে।
এছাড়া প্রতিবেশীর রয়েছে আইনী অধিকার। ভবন বা ভবনসংলগ্ন রাস্তা বা এর সঙ্গে সংযোগকারী কমপক্ষে ৩ দশমিক ৬৫ মিটার প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন রাস্তার ক্ষেত্রে কমপক্ষে ৩ মিটার প্রশস্ত রাস্তা থাকতে হবে। মালিকানা উল্লেখ না থাকলে রাস্তা সর্বসাধারণের রাস্তা হিসেবেই গণ্য হবে। দুই রাস্তার সংযোগস্থলের কোণে ১ মিটার জায়গা রাস্তা সরলীকরণের জন্য উন্মুক্ত রাখতে হবে। কাছের কোনো রাস্তার কেন্দ্র থেকে কমপক্ষে সাড়ে ৪ মিটার অথবা রাস্তাসংলগ্ন সীমানা থেকে কমপক্ষে দেড় মিটার দূরে ভবন নির্মাণ করতে হবে। অর্থাৎ ভবন বানাতে গিয়ে কোনোভাবেই প্রতিবেশীদের অধিকার ক্ষুণœ করা যাবে না। ইচ্ছা করলেই প্রতিবেশীর জায়গার ওপর কিংবা রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করা যাবে না। ঢাকা ও চট্টগ্রামের জন্য প্রতিটি ভবনে কমপক্ষে ২৩ বর্গমিটার জায়গা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখতে হবে। আর বাণিজ্যিক স্থানে সরকারি কর্তৃপক্ষের নির্ধারণ করে দেওয়া জায়গা গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য রাখতে হবে। ভবনের ছাদ এমনভাবে নির্মাণ করতে হবে, যাতে ওই ছাদের পানি রাস্তায় বা অন্যের জমিতে কিংবা ভবনে না যায়। ছাদ বা কার্নিশ উন্মুক্ত স্থানের ওপর আধা মিটারের অর্ধেকের বেশি বাড়ানো যাবে না। ভবনের দরজা ও জানালার ওপর হাফ মিটার প্রস্থের বেশি সানশেড নির্মাণ করা যাবে না।
ঢাকাসহ অন্যান্য মহানগরে কার্যকর রয়েছে মহানগর পুলিশ অধ্যাদেশ। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনগুলোয় রয়েছে সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশ। প্রতিবেশীর বাসার সামনে ইচ্ছা করলেই পশু জবাই করা যাবে না। অনুমোদিত স্থান ছাড়া পশু জবাই ও কাটাকাটি করা যাবে না। আপনার বাসার ময়লা-আবর্জনা ইচ্ছা করলেই যেখানে-সেখানে ফেলে রাখতে পারবেন না। ইচ্ছা করলেই এমনভাবে থুথু বা পানের পিক ফেলতে পারবেন না, যাতে প্রতিবেশীর গায়ে পড়ে কিংবা চলাচলে সমস্যা হয়। ফেলতে হবে নির্ধারিত স্থানে। রাস্তার ধারে যেখানে-সেখানে ইচ্ছা করলেই মলমূত্র ত্যাগ করা যাবে না। আপনার মন চাইলেই কোনো বিশেষ দিন উপলক্ষে প্রতিবেশীর বাসার সামনে কিংবা এলাকার রাস্তায় সংগীত, কৌতুক বা যে কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করা যাবে না। রাস্তায় কিংবা কোনো প্রকাশ্য স্থানে কাপড় ধোয়া ও গোসল করা যাবে না। কোনোভাবেই প্রতিবেশীর সঙ্গে অশালীন আচরণ করা যাবে না। উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ প্রমাণিত হলে ভ্রাম্যমাণ আদালত দুই বছর পর্যন্ত সাজা দিতে পারে। আপনি ইচ্ছা করলেই অনুমোদন না নিয়ে যখন-তখন প্রতিবেশীর বাসায় ঢুকে পড়তে পারবেন না। আপনার পালিত কোনো পশু-পাখি রাস্তায় ছেড়ে রাখতে পারবেন না। প্রতিবেশীর বাসার দালানে কোনো পোস্টার বা বিজ্ঞাপন লাগানো যাবে না। সমাজে বাস করতে গেলে এসব বিধিনিষেধ আপনাকে মেনে চলতেই হবে। যদি না মানেন, তাহলে কমপক্ষে ১০০ থেকে শুরু করে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হতে পারে এবং এর সঙ্গে খাটা লাগতে পারে জেলেও। আইন অনুযায়ী কোনো ক্ষতিগ্রস্ত বা বিরক্তির শিকার প্রতিবেশী পুলিশের কাছে লিখিত প্রতিকার চাইতে পারেন। এ ছাড়া প্রতিবেশীর অধিকার রয়েছে টর্ট আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণের মামলা করারও। এ ছাড়া ইমারত নির্মাণ আইন, ১৯৫২ ও ২০০৬ অনুযায়ী ভবন নির্মাণ যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে, সে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ভবন ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ আবাসিক বাড়ির জন্য অনুমতি নিলে ওই ভবনকে আবাসিক কাজেই ব্যবহার করতে হবে, অন্য কোনো কাজে যেমন বাণিজ্যিক বা ব্যবসার জন্য ব্যবহার করা যাবে না। এ নিয়ম না মানলে প্রতিবেশীরা নিতে পারেন আইনের আশ্রয়। তারা যদি এমন কোনো ভবনের বিষয়ে অভিযোগ করেন তাহলে সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ ওই ভবন ভেঙে ফেলার বা অপসারণের নির্দেশ দিতে পারবে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮