শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৯ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
আপনি বা আপনার পরিবারের কোন সদস্য বা প্রতিবেশী যদি নারী নির্যাতনের শিকার হন, এসিড সন্ত্রাসের শিকার হন, নারী বা শিশু পাচারের শিকারের হন, অপহরণের শিকার হন, ধর্ষণের শিকার হন, কিংবা যৌতুক, আত্মহত্যার প্ররোচনা, যৌণ নিপীড়ন কিংবা সংবাদ মাধ্যমে নির্যাতিত নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশ করে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে থাকে, তাহলে আপনি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ সংশোধিত ২০০৩ অনুযায়ী মামলা করে প্রতিকার পেতে পারেন।
এ ধরণের যে কোনো ঘটনার শিকার হলে বিচারপ্রার্থীর প্রথম কাজ হলো পার্শ্ববর্তী থানায় বিষয়টি জানানো। কোনো কারণে থানায় পুলিশ যদি মামলা নিতে না চায়, তাহলে সরাসরি সংশ্লিষ্ট নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে (বিচারিক হাকিম) আদালতে নালিশি অভিযোগের মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার চেয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন।
এ ক্ষেত্রে মামলাকারী ব্যক্তি প্রথমে নারী ও শিশু নির্যাতন অপরাধ দমনে নিযুক্ত নারী ও শিশু পাবলিক প্রসিকিউটরের (পিপি নারী ও শিশু) কাছে প্রত্যয়ন ও সত্যায়িত করে মামলা করতে হবে। ওই আদালতের নিযুক্ত কর্মচারীর সামনে ঘটনার সত্যতা স্বীকারে একটি হলফনামাও সম্পাদন করতে হবে। এ ছাড়া আবেদনটি বিচারকের সামনে হাজির করার সময় অভিযুক্তকে আদালতে উপস্থিত হয়ে জবানবন্দী দিয়ে মামলা করতে হবে। আদালত অভিযুক্তের জবানবন্দি শোনার পর ওই অভিযোগের কোনো ভিত্তি আছে কি-না, তা পরীক্ষা করার উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট বিচারক অভিযোগকারীকে এবং প্রয়োজন মনে করলে ঘটনার কোনো সাক্ষী থাকলে তাঁদের শপথের মাধ্যমে পরীক্ষা করবেন। পরীক্ষার সারসংক্ষেপ লিখে তিনি নিজে, অভিযোগকারী ব্যক্তির ও কোনো সাক্ষী থাকলে তাঁর স্বাক্ষর নেবেন। এ রকম অভিযোগে একটি কমপ্লেইন রেজিস্টার কেস নম্বর বা কমপ্লেইন রেজিস্টার পিটিশন কেস নম্বর দিয়ে নথিভুক্ত হয়। শপথ পরীক্ষার সময় এবং জবানবন্দি নেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট বিচারক যদি অপরাধ সংঘটন বিষয়ে অভিযোগকারীর বক্তব্যে সন্তুষ্ট না হন অথবা অভিযোগকারী মামলার ভিত্তি প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন, তবে বিচারক মামলাটি আমলে না নিয়ে আবেদনটি খারিজ করে দিতে পারেন।
নালিশি পিটিশনটি খারিজ হলে অভিযোগকারী খারিজ আদেশের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্ট বিভাগে ওই আদেশের বিরুদ্ধে রিভিশনের আবেদন করতে পারেন। তবে প্রয়োজন মনে করলে বিচারক অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য অথবা অধিকতর তদন্তের জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত করার উদ্দেশ্যে তিনি নিজে বা তাঁর অধস্তন অন্য কোনো ম্যাজিস্ট্রেটকে বিষয়টি তদন্ত করার নির্দেশ দিতে পারেন। অভিযোগটির সত্যতা যাচাইয়ের জন্য বিচারক স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদেরও তদন্তকাজে সম্পৃক্ত করতে পারেন। আবার অভিযোগটি সত্য মনে হলে পারিপার্শ্বিক বিবেচনায় আমলে নিয়ে বিচারক ক্ষেত্র বিশেষে ওয়ারেন্ট জারি করতে পারেন।
থানা পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে হাইকোর্টে রিট দায়ের করে প্রতিকার চাওয়া যায়। রিট আবেদনে ভিকটিম বা তার পরিবার থানায় মামলা দায়েরের অনুমতি প্রদান ও আসামিদের গ্রেফতারের আদেশ প্রার্থনা করতে পারেন। হাইকোর্ট বিভাগ রায় প্রদান করলে পুলিশ রায় মানতে বাধ্য। এরপর রয়েছে মানবাধিকার কমিশনে অভিযোগ। পুলিশ মামলা নিতে না চাইলে প্রতিকার চাওয়ার আরেকটি মাধ্যম হলো জাতীয় মানবাধিকার কমিশন।
বিচারক মামলাটি আমলে নিলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের মামলায় বাদীর বা এজাহারকারীর নিজস্ব কোনো আইনজীবী নিয়োগের প্রয়োজন নেই। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯২ ধারা অনুযায়ী তিনি সরকারের পক্ষ থেকে আইনজীবী পাবেন। তিনি মামলার সব তত্ত্বাবধান করবেন। যদি বাদী নিজে আইনজীবী নিয়োগ দিতে চান তাহলে সেই আইনজীবী সরকারি আইনজীবীর অধীনে কাজ করবেন। সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগ দেওয়া আইনজীবীকে কোনো খরচ দিতে হবে না।
দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। এই আইনে ট্রাইব্যুনাল রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচার পরিচালনাও করতে পারেন। কোনো ব্যক্তির আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বা স্বীয় বিবেচনায় উপযুক্ত মনে করলে বিচারক শুধু মামলার দুই পক্ষকে এবং তাদের নিয়োজিত আইনজীবীদের নিয়ে বিচার পরিচালনা করতে পারেন। তা না করলে বিধান মোতাবেক বিচার পরিচালিত হবে।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধিত আইন ২০০৩ অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল ১৮০ দিনের মধ্যে বিচারকাজ শেষ করবেন। ট্রাইব্যুনাল যদি ১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার কারণসংবলিত একটি প্রতিবেদন ৩০ দিনের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করবেন। যার একটি অনুলিপি সরকারকেও দিতে হবে।
তাছাড়া এ ক্ষেত্রে পাবলিক প্রসিকিউটর ও সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তা ৩০ দিনের মধ্যে সরকারের কাছে কারণ উল্লেখপূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করবেন। এ রকম দাখিলকৃত প্রতিবেদনগুলো যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বিবেচিত হওয়ার পর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়ার জন্য দায়ী ব্যক্তি বা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই আইন অনুযায়ী পুলিশ যদি অভিযোগ গ্রহণ না করে সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল সরাসরি বিচারের জন্য অভিযোগ নিতে পারেন। এই বিধানটি যদি বাস্তবে প্রয়োগ করা হয়, তবে জনগণের অভিযোগ করা অনেক সহজ হবে।
এই আইনের অধীন বিচার চলাকালে যদি ট্রাইব্যুনাল মনে করেন কোনো নারী বা শিশুকে নিরাপত্তামূলক হেফাজতে রাখা প্রয়োজন, তাহলে ট্রাইব্যুনাল ওই নারী বা শিশুকে কারাগারের বাইরেও সরকার কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে বা যথাযথ অন্য কোনো ব্যক্তি বা সংস্থার হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিতে পারেন। বিচার চলাকালে যদি অপরাধী মহল নির্যাতিত নারী বা শিশুকে আবার কোনো ধরনের আঘাত করে বা করতে চায়, তা থেকে রক্ষার জন্য এই বিধান। তাছাড়া অভিযুক্তকে চিকিৎসা দেওয়ার জন্যও হেফাজতে রাখার নির্দেশ দিতে পারে ট্রাইব্যুনাল। তবে কোনো নারী বা শিশুকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার আদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল ওই নারী বা শিশুর মতামত গ্রহণ ও বিবেচনা করবেন।
আর এ মামলার তদন্ত বিষয়ে বলা হয়েছে যে, অভিযুক্ত ব্যক্তি হাতেনাতে পুলিশের হাতে আটক হওয়ার পর ১৫ দিনের মধ্যে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা তদন্ত শেষ করবে। আর অপরাধী ধরা না পড়লে তদন্তের নির্দেশ পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত সমাপ্ত না হলে তার কারণ ব্যাখ্যা করে সময় শেষ হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ট্রাইব্যুনালকে জানাতে হবে। ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছে করলে অন্য কর্মকর্তার ওপর তদন্তভার অর্পণের আদেশ দিতে পারেন। এই আদেশ দেওয়ার সাত দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করতে হবে। আর এ মামলায় শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছে এসব অপরাধ প্রমাণিত হলে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন থেকে মৃত্যুদ-ও হতে পারে। এ ছাড়া রয়েছে অর্থদ-ের বিধান।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইন গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ইমেইলঃseraj.pramanik@gmail.com