বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১০:৪৩ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: আমাদের দেশে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃত হিজড়াদের আইনী অধিকার, সাংবিধানিক অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, ধর্ম পালনের অধিকার ও বিয়ে অধিকার নিয়ে রয়েছে নানারককম ধু¤্রজাল।
লিঙ্গ পরিচয়ের ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের বাইরে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে ‘উভলিঙ্গ’ কিংবা ‘ট্রান্সজেন্ডার’ বা ‘রূপান্তরিত লিঙ্গ’-এর স্বীকৃতি আমাদের দেশে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ২০১৪ সালের ২৬ জানুয়ারি হিজড়াদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দিয়ে গেজেটে এই জনগোষ্ঠীকে ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। রাষ্ট্রীয়ভাবে তৃতীয় লিঙ্গের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে হিজড়াদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় এবং নাগরিকত্বের সনদ বা জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট করার বাঁধা দূর হয়েছে। কিন্তু নাগরিক হিসেবে সংবিধান স্বীকৃত কিছু আইনি অধিকার পেলেও যৌন নির্যাতনের মতো ঘটনায় আইনি প্রতিকার পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। কারণ নারী ও শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন, ধর্ষণ এবং ধর্ষণ চেষ্টার ক্ষেত্রে প্রচলিত আইনে বিচারের ব্যবস্থা থাকলেও হিজড়াদের ওপর যৌন নির্যাতনের বিচারের ব্যবস্থা নেই। তাদের ভাষায় কিছু বিকৃত রুচির পুরুষ তাদের বিকৃত যৌনকামনা পূরণ করতে অনেককেই বাধ্য করে থাকেন।
কিন্তু আইনি প্রতিকারের পথ না থাকায় ও লোকলজ্জার কারণে হিজড়ারা সবকিছু নীরবে সয়ে যান। আর হিজড়াদের যৌন নির্যাতন করা হলে সেটি ধর্ষণ নাকি বলাৎকার সে বিষয়েও কারও কোনো ধারণা নেই।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে নারী ও শিশুদের প্রতি শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের বিষয়ে বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও হিজড়া সম্প্রদায়ের মানুষরা এ ধরনের পরিস্থিতিতে কী করবেন, কার কাছে বিচার চাইবেন তা নিয়ে আইনে কোন কিছু বলা নেই।
তবে হিজড়াদের মধ্যে আমাদের ধর্মীয় আইন অনুযায়ী কিভাবে সম্পত্তি বন্টিত হবে, পিতা-মাতার কোনো সন্তান যদি হিজড়া হয় তাহলে তিনি ছেলে না মেয়ে হিসেব সম্পত্তি পাবেন, তাদের মধ্যে কোন শ্রেণীর হিজড়া বিয়ে করতে পারবেন-এসকল বিষয়ে এবার জেনে নেয়া যাক।
বাংলা অভিধান ও গবেষকদের গবেষণা মতে হিজড়া হচ্ছে- এমন ব্যক্তি যিনি প্রকৃত অর্থে পুরুষ হলেও নারীর মতো আচার-আচরণ ও পোশাক-পরিচ্ছদ পছন্দ করেন অথবা যিনি মেডিকেল অপারেশনের মাধ্যমে তার লিঙ্গ পরিবর্তন করেছেন। শারীরিক গঠন অনুযায়ী পৃথিবীতে মোট চার ধরনের হিজড়া দেখা যায়। ক. পুরুষ (তবে নারীর বেশে চলে) তাদের আকুয়া বলা হয়। এরা মেয়েদের বিয়ে করতে পারে। খ. নারী (নারীর বেশে চলে, তবে দাড়ি-মোঁচ আছে)। তাদের জেনানা বলা হয়। তারা ইচ্ছা করলে পুরুষের কাছে বিয়ে বসতে পারে। গ. লিঙ্গহীন (বেশে যাই হোক)। আরবিতে তাদের ‘খুনসায়ে মুশকিলা’ বলা হয়। এই শ্রেণির হিজড়া আসলে কারা, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেবেন অভিজ্ঞ চিকিৎসক। ঘ. কৃত্তিমভাবে যৌন ক্ষমতা নষ্ট করে বানানো হিজড়া। তাদের খোঁজা বলা হয়। যৌন অক্ষমতার দরুণ তারা বিয়ে করতে পারে না বা বিয়ের পিঁড়িতে বসতেও পারে না। উল্লেখিত চার ধরনের হিজড়ার মাঝে আকুয়া এবং জেনানাদের লিঙ্গ নির্ধারণ দৃশ্যতঃ সম্ভব হলেও এদের অনেকের লিঙ্গ কাজের বেলায় অক্ষম কিংবা জননে ব্যর্থ। সেক্ষেত্রে তাদের জন্য বিয়ে হারাম।
হিজড়া কীভাবে নিধারিত হবে কিংবা তাদের সম্পত্তির শ্রেণীবিন্যাস প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে। হজরত আলী (রা.) হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে প্রসূত বাচ্চা পুরুষ-নারী নির্ধারণ করতে না পারলে তার বিধান কি-জিজ্ঞাসা করলেন। হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) জবাব দিলেন, সে মিরাস পাবে যেভাবে প্র¯্রাব করে।
মুসলিম আইনে উত্তরাধিকারীত্বের ক্ষেত্রে দুইটি দিক নির্দেশনা লক্ষ্য করা যায় যেমন: ১। প্রতিবন্ধকতা ২। অ-প্রতিবন্ধকতা। উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বা বঞ্চিত ব্যক্তিগণ হচ্ছে- ক) ক্রীতদাস খ) হত্যাকারী গ) ধর্ম পরিবর্তনকারী ঘ) আঞ্চলিকভাবে বঞ্চিত ব্যক্তি। এ সকল ক্ষেত্রে স্ত্রী লিঙ্গের কোন বর্ণনা নাই। পুরুষ এবং স্ত্রীলোক ক্রীতদাস, হত্যাকারী, ধর্ম পরিবর্তনকারী হতে পারে।
অ-প্রতিবন্ধকতা শ্রেণীর উত্তরাধিকারী হচ্ছে- ক। অংশীদার খ। অবশিষ্ট ভোগী গ। দূরবর্তী জ্ঞাতি ঘ। অসম্পর্কিত উত্তরাধিকারী এবং ঙ। বিবিধ প্রকার উত্তরাধিকারী। তাছাড়া মুসলিম আইনে উত্তরাধিকারের ক্ষেত্রে সকল সুস্বাস্থের অধিকারী সহ শারীরিক অক্ষমতা, বিকলঙ্গতা, অঙ্গহানী, প্রতিবন্ধি এবং তৃতীয় লিঙ্গকে উত্তরাধিকারীত্ব থেকে বঞ্চিত করা হয়নি। কেবলমাত্র মুসলিম বিবাহের ক্ষেত্রে যৌন-অক্ষম ব্যক্তিকে বিবাহ করা হতে নিষেধ বা নিবৃত্ত করা হয়েছে।
যেসব হিজড়ার মাঝে পুরুষালি স্বভাবের প্রাধান্য থাকে তাদেরকে পুরুষ আর যাদের মাঝে নারী স্বভাবের প্রাধান্য তাদেরকে নারী হিসেবে বিবেচনা করে সম্পত্তি বণ্টনের বিধান দিয়েছে ইসলাম। আর যেসব হিজড়ার মাঝে নারী-পুরুষ উভয় বৈশিষ্ট্যই সমভাবে বিদ্যমান, তাদেরকে নারী হিসেবে সম্পত্তি প্রদানের বিধান দিয়েছে ইসলাম।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮