এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
বাংলাদেশে ছোটবড় প্রায় ২৫০ টি নদী আছে। এছাড়া অসংখ্য খাল, বিল, হাওড় আছে। যে এলাকার নদীর পাড় ভাঙতে থাকে সে এলাকার মানুষ সর্বস্বান্ত হয়। লোকে বলে ঘর পুড়লে মাটি থাকে কিন্তু নদী ভাঙলে কিছু থাকে না। নদী ভাঙলেও কোনো না কোনো এলাকায় আবার চর পড়তে থাকে। নতুন চর জাগলে সবাই তো ভোগ দখল করতে পারে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়া জমির মালিক জেগে ওঠা চরের মালিক হয়। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভেঙে যাওয়া জমির মালিক চরের মালিক না হয়ে সরকার চরের মালিক হয়। চরের জমি ভেঙে আবার জেগে উঠলে কী অধিকার বা প্রতিকার আছে তা অনেকে জানেন না। এই না জানার জন্য অনেকে প্রতিকার পায় না। সরকারি অফিসের সাহায্যও নিতে পারে না।
২৮ জুন ১৯৭২ সাল থেকে ১৩ জুলাই ১৯৯৪ সালের মধ্যে জমি নদী বা সমুদ্রগর্ভে ভেঙে গিয়ে আবার চর হিসেবে জেগে উঠলে সেই চরের মালিক হতো সরকার। তবে ১৩ জুলাই ১৯৯৪ সালের আগে জেগে ওঠা চর যদি সরকার বা জেলা প্রশাসক বন্দোবস্ত দিয়ে থাকে তবে বন্দোবস্ত গ্রহীতা মালিক হতো। ১৩ জুলাই ১৯৯৪ সালে নতুন আইন জারি করা হয়েছে। এই আইনে নদীগর্ভে কারও জমি ভেঙে গেলে এবং সেই জমি ৩০ বছরের মধ্যে জেগে উঠলে পুরানো মালিক সেই চরের মালিক হবে। ত্রিশ বছরের মধ্যে জেগে না উঠলে অবশ্য সরকার মালিক হবে। কিন্তু সরকারকে এই জমি দখল নিতে দেখা যায় না।
কারও জমি নদীগর্ভে চলে গেলে আইন অনুযায়ী উপজেলা ভূমি অফিসে জানানো উচিত। আর মনে রাখবেন নদীগর্ভে জমি চলে গেলে সেই জমির ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা দরখাস্ত দিয়ে মাফ করিয়ে নেয়া যায়। দরখাস্ত দিয়ে খাজনা কমিয়ে রাখলে পরবর্তীকালে প্রমাণ করা সহজ হবে যে, আপনি ভেঙে যাওয়া জমির মালিক ছিলেন। তাই লিখিতভাবে জানিয়ে রাখলে জমি ফেরত পাওয়া সহজ হয়।
আপনারা জানেন ২৫ বিঘা পর্যন্ত কৃষি জমির মালিককে কোন ভূমি উন্নয়ন কর বা খাজনা দিতে হয় না। তাই ২৫ বিঘার কম জমির মালিকের জমি নদীতে ভেঙে গেলে ভূমি উন্নয়ন কর কমানোর প্রশ্ন আসে না। তবে দু’টাকা দিয়ে মওকুফ দাখিলা নেয়া যায়। জমি ভেঙে যাওয়ার পর জেগে উঠলে ফেরত পাওয়ার ব্যাপারে মওকুফ দাখিলাও মালিকানা প্রমাণের সাক্ষ্য হিসেবে কাজে লাগে। আর আপনার সিকস্তি জমি চর হিসেবে জেগে উঠলে উপজেলা ভূমি অফিসে দরখাস্ত দিয়ে ফেরত চাইতে হবে। চর হিসেবে জেগে উঠলে আপনার দলিল, খতিয়ান, দাখিলা, ভূমি উন্নয়ন কর মওকুফ আদেশ ইত্যাদি উল্লেখ করে দরখাস্ত দিতে হয়। জমির দলিলপত্রের ফটোকপি দরখাস্তের সাথে দিতে হবে। কোন কোন দলিলপত্র দিলেন তা দরখাস্তের নিচে লিখে দিলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) বুঝতে পারবেন আপনি দলিলপত্রগুলি দিয়েছেন। শুনানি করে সহকারী কমিশনার (ভূমি) আপনার জমির দখল ও মালিকানা ফিরিয়ে দিলে ভূমি উন্নয়ন কর জমা দিয়ে দাখিলা নিন। দাখিলা ভূমি উন্নয়ন কর পরিশোধের রসিদ ছাড়াও দখলের প্রমাণ। বর্তমানে অগ্রিম তিন বছরের ভূমি উন্নয়ন কর জমা দিয়ে দাখিলা নেয়া যায়। তাই জমি জেগে ওঠার সাথে সাথে সহকারী কমিশনার (ভূমি)-র সাথে দেখা করে দরখাস্ত দিয়ে জমি বুঝিয়ে দিতে বলুন। এই দরখাস্ত পাওয়ার পর তিনি সার্ভেয়ার দিয়ে সরেজমিনে মাপ দিয়ে একটি ম্যাপ তৈরি করবেন। এরপর ঐ জমির দখল নেবেন। জমির মালিক সরাসরি জমির দখল নিতে পারবেন না। তারপর এই জমিতে কে কে মালিকানা দাবি করে তাদের কাছ থেকে দরখাস্ত চেয়ে নোটিশ দিবেন। মালিক দাবিদারদের বক্তব্য শুনে ও দলিলপত্র পরীক্ষা করে সহকারী কমিশনার (ভূমি) প্রকৃত মালিক বের করবেন। প্রকৃত মালিকের জমি ও দখল বুঝিয়ে দিবেন। উপজেলা ভূমি অফিসে দরখাস্ত দেয়ার বা চর জাগার খবর জানার ৪৫ দিনের মধ্যে এই কাজ শেষ করার ব্যাপারে সহকারী কমিশনার (ভূমি)-এর প্রতি আইনের নির্দেশ আছে। তিনি শুনানি করে অন্য কাউকে দখল বুঝিয়ে দিলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)-এর কাছে আপিল করুন। ১৫ দিনের মধ্যে আপিল না করলে আবেদনের সময় তামাদি হয়ে যায়। তবে যদি বুঝাতে পারেন যে আপনি সময়মত জানতে পারেননি কিংবা আপানর অজান্তে অন্যের কাছে জমি বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে তবে আরো সময় পেতে পারেন। আপনার দরখাস্তটি ফেলে রাখলে জেলা প্রশাসক বা অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব)-এর সাথে দেখা করে ঘটনা বলুন। প্রয়োজনে লিখিত দিন। এরপরও অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) এবং তাঁর আদেশের বিরুদ্ধে ভূমি আপিল বোর্ডে আপিল করা যায়। মনে রাখবেন জেগে ওঠা চর জমি নদীতে ভেঙে যাওয়ার আগে যিনি মালিক ছিলেন সবক্ষেত্রে তিনি ফেরত পাবেন না। যারা ৬০ বিঘা জমির মালিক তারা পয়স্তি জমি ফেরত পাবেন না। তবে ৬০ বিঘার কম থাকলে ৬০ বিঘা পূরণ হতে যেটুকু জমি লাগে সেটুকু ফেরত পাবেন। বাকি জমি ফেরত পাবেন না, খাস হবে।
আর যে জমি নদী বা সমুদ্রগর্ভে ছিল, কেউ কখনও মালিক ছিল না, সে জমি জেগে উঠলে তার মালিক সরকার। ১৩ জুলাই ১৯৯৪ সাল থেকে ভেঙে যাওয়া জমি ৩০ বছর পর জেগে উঠলে খাস হিসেবে ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেয়া যাবে। আপনি ভূমিহীন হলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) এর কাছে এভাবে জেগে ওঠা খাস জমি স্থায়ী বন্দোবস্ত পাওয়ার জন্য দরখাস্ত করতে পারেন। যাদের কোন জমিই নেই বা যাদের শুধু ১০ শতাংশ পর্যন্ত বসতবাড়ীর জমি আছে অথচ পরিবারটি কৃষিনির্ভর তারাই ভূমিহীন কৃষক। কৃষিনির্ভর বলতে বর্গাচাষী, কৃষি দিনমজুর ইত্যাদি বুঝায়। প্রত্যেক উপজেলায় খাস কৃষি জমি বরাদ্দ দেয়ার জন্য একটা কমিটি আছে। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এই কমিটির সভাপতি। আপনার এলাকার ইউনিয়ন পরষদের চেয়ারম্যান এই কমিটির সদস্য, তার সাথে যোগাযোগ রাখুন।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। Email: seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com