এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
সম্প্রতি হেফাজত নেতা মামুনুল হকের পরকীয়া, ক্রিকেটার নাসিরের পরস্ত্রীকে বিয়ে নিয়ে আলোচনা সমালোচনা, পরস্ত্রীকে বিয়ের ক্ষেত্রে আইনী জটিলতা, পরকীয়ার সাজা, ভূক্তভোগীর আইনী প্রতিকারে জটিলতা নিয়ে আজকের নিবন্ধ।
পরকীয়া হচ্ছে বিবাহিত জীবন থাকা স্বত্ত্বেও অন্য কোনো নারী বা পুরুষের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়া। বেশির ভাগ পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে উঠে নারী বা পুরুষের শারিরীক ও মানসিক চাহিদা মেটানোর জন্য। মোবাইল ফোন, ফেসবুকসহ নানা প্রযুক্তি মানুষের হাতের মুঠোয় হওয়ায় পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তোলাও অনেক সহজ। পরকীয়ার সাজা সংক্রান্ত দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারায় বলাা হয়েছে যে, কোনও ব্যক্তি কোনও মহিলার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলে এবং ওই মহিলার স্বামীর অনুমতি না থাকলে পাঁচ বছর পর্যন্ত জেল এবং জরিমানা বা উভয়ই হতে পারে। কোনো স্ত্রী পরকীয়া করলে যার সঙ্গে পরকীয়া করবে শুধু সেই ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির বিধান রয়েছে। অথচ স্ত্রীর বিরুদ্ধে স্বামীর কিছুই করার নেই। একইভাবে স্বামী পরকীয়া করলে স্ত্রী স্বামীর বিরুদ্ধে বা যার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িত হবে তার বিরুদ্ধে কোনো প্রতিকার পাবেন না। উপরুন্ত স্বামী যদি কোনো বিধবা বা অবিবাহিত নারীর সঙ্গে পরকীয়া জড়িয়ে পড়েন এবং স্ত্রী যদি স্বামীর অনুমতি সাপেক্ষে পরকীয়ায় জড়িত হয় তা আইনত বৈধ। সেকারণ ভারত এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের উচ্চ আদালত এ ধারাটি কেন অবৈধ এবং অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন এই আইন স্বেচ্ছাচারিতার নামান্তর। মহিলাদের স্বাতন্ত্র্য খর্ব করে। স্বামী কখনই স্ত্রীর প্রভু বা মালিক হতে পারেন না। তবে বিবাহ বিচ্ছেদের কারণ হতে পারে বলে মত দিয়েছেন।
একটি কেইস ষ্টাডি আপনাদের মাঝে উপস্থাপন করলে বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে। সুজন ও রীতার দাম্পত্য জীবন ভালই চলছিল। হঠাৎ একটি মোবাইল ফোন তাদের সুখের সংসারকে তছনছ করে দেয়। সুজনের এক বন্ধু তাকে ফোন করে জানান যে তার স্ত্রী রিতা অন্য একটি ছেলের সঙ্গে বসুন্ধরা সিটিতে ঘোরাফেরা করছে। ব্যবসায়ী সুজন বসুন্ধরা সিটিতে তখনই গিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে থাকা ছেলেটির পরিচয় জানতে চান। এ সময় সুজনের স্ত্রী উল্টো তাকে প্রশ্ন করেন ‘আপনি কে? আপনাকে তো আমি চিনি না।’ সুজন রাগ সংবরণ করতে না পেরে স্ত্রীকে তখন কয়েকটি থাপ্পড় মারেন। নারীর গায়ে হাত তোলার অপরাধে উপস্থিত নিরাপত্তা রক্ষীরা সুজনকে পাকড়াও করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেন। পরে পুলিশের জেরায় সব সত্য প্রকাশ করেন রিতা। এসময় রিতার প্রেমিক পুলিশকে বলেন, ‘রিতার সঙ্গে আমার এক বছরের সম্পর্ক। অবিবাহিত হিসেবে পরিচয় দিয়েছে আমার কাছে। সে আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছে।’ এসময় স্বামীকে না চেনার ভান করায় সুজনও রিতাকে ঘরে নিতে অস্বীকার করেন। ঘটনার কিন্তু এখানেই শেষ নয়! শেষমেষ রিতা সুজনের কাছে ক্ষমা চায় এবং প্রেমিক ওই পুরুষটি তাকে ভুল বুঝিয়ে এ পথে নামিয়েছে জানিয়ে তার বিচার দাবী করেন। সুজন শেষমেষ রীতার কথামতো ওই প্রেমিক পুরুষের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা ঠুকে দেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে এই যে, ব্যভিচারের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই। ওই স্ত্রীলোকটি যে দুষ্কর্মের সহায়তাকারিণী বা ব্যভিচারের অপরাধে দোষী অথচ তিনি কোন সাজা পাবে না। এ বিষয়ে মহামান্য লাহোর হাইকোর্ট একটি নজিরবিহীন সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, যা পাকিস্তান লিগ্যাল ডিসিশন, ১৯৭৪ সন্নিবেশিত রয়েছে। মহিলা আসামী হতে পারে না। তবে ওই পুরুষটির সাজা দিতে হলে অভিযোগকারীকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে যে, ওই মহিলার সাথে যৌন সঙ্গম করার সময় আসামী জানত অথবা জানার যুক্তিসঙ্গত কারণ ছিল যে, যৌণ সঙ্গমকারী মহিলা অপর কোন ব্যক্তির স্ত্রী।
উল্লেখ থাকে যে, কোন মহিলাকে তার পূর্বের স্বামী তালাক দিয়েছেন এই সরল বিশ্বাসে আসামী বিবাহ করলে তাকে এ ধারার অধীন দোষী সাব্যস্থ করা যায় না। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে মহিলার সাথে যৌণ সঙ্গম করা হয় সে মহিলা ওই সময় বিবাহিত না হলে এই ধারার অধীনে কোন অপরাধ আমলে আনা যায় না। এ ধারা অধীন শাস্তি দিতে হলে বিবাহের বিষয়টি যথাযথভাবে প্রমাণ করতে হয়। তবে মহামান্য লাহোর হাইকোর্ট বলেছেন, অবিবাহিত পুরুষ ও স্ত্রীলোক যদি দীর্ঘদিন ধরে একত্রে বসবাস করে তাহলে বলা যাবে না যে, তারা ব্যাভিচারের অপরাধ করেছে। (পিএলডি ১৯৬২, ৫৫৮)।
সুজনের মামলায় রীতার সেই পরকীয়া প্রেমিক আসামীকে সাজা দিতে হলে সুজনকে পাঁচটি বিষয় অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে। প্রথমতঃ আসামী কোন নারীর সাথে যৌণ সঙ্গম করেছিল, দ্বিতীয়তঃ উক্ত নারী বিবাহিত ছিল, তৃতীয়তঃ আসামী বিবাহের বিষয়টি জানত এবং তা বিশ্বাস করার কারণও ছিল, চতুর্থতঃ ওই যৌণ সঙ্গম নারীর স্বামীর সম্মতি বা সমর্থন ব্যতিরেকে হয়েছিল, পঞ্চমতঃ ওই যৌণ সঙ্গম নারী ধর্ষণের সামিল ছিল না। যেহেতু সাক্ষ্য আইনের ১০১ ধারামতে কোন ঘটনা প্রমাণের দায়িত্ব বাদীর। গোপাল চন্দ্র বনাম লাসমত দাসী মামলা যা ৩৪ ডিএলআর, ১৪৫ পৃষ্টায় উল্লেখ রয়েছে যে, বিচার্য বিষয় সম্পর্কে যে পক্ষ কোন ঘটনার অস্তিত্বের দাবী করে সে পক্ষই তা প্রমাণ করবে। এ মামলায় আসামী যে রিতার সাথে ব্যভিচারী করেছে, বাদী সুজন প্রমাণ করতে সক্ষম হওয়ায় বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আসামীকে পাঁচ বছরের বিনাশ্রম কারাদণ্ড, সেই সাথে অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করে রায় প্রদান করেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com