শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৫ পূর্বাহ্ন
নিজস্ব প্রতিবেদকঃ
পরকীয়া নিয়ে স্ত্রীর সাথে কথাকাটাকাটির এক পর্যায়ে কুষ্টিয়ায় কাস্টমস মোড় এলাকায় স্ত্রীকে খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন এএসআই সৌমেন। সেই সময় পালিয়ে গিয়েও রক্ষা পায়নি ছেলে রবিন। সৌমেন রায় যখন পিস্তল বের করে গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন, তখন ভয়ে দৌঁড়ে পালাতে থাকে রবিন। তখন সৌমেন পেছন থেকে গুলি করে রবিনকে হত্যা করেন। এরপর খুব কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন স্ত্রী আসমা খাতুনকে।
পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) সৌমেন রায় রোববার সকালে হত্যাকা-ে ১১ রাউন্ড গুলি খরচ করেছেন বলেও জানা গেছে জেলা পুলিশের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্রে। খুলনার ফুলতলা থানায় কর্মরত এএসআই সৌমেন রায় এ হত্যাকা-ে সরকারি অস্ত্র ও গুলি ব্যবহার করেছে বলেও নিশ্চিত করেছে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ।
জেলা পুলিশের সিনিয়র ক’জন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্ত্রীর ‘পরকীয়ার’ জের ধরে সৌমেন এই হত্যাকা- ঘটিয়ে থাকতে পারেন। স্পর্শকাতর বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করে তদন্ত শুরু করেছে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ। জেলা পুলিশের সূত্রটি জানিয়েছে, ওয়ারেন্ট জারির কথা বলে সৌমেন খুলনার ফুলতলা থানা থেকে সরকারি অস্ত্র ও গুলি নিয়ে এসেছিলেন।
কাস্টমস মোড় এলাকার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী হত্যাকা-ের বিস্তারিত জানান। তাদের ভাষ্যে, রোববার বেলা ১১টার দিকে সৌমেন তার স্ত্রী আসমা ও ছেলে রবিনকে নিয়ে কাস্টমস মোড় এলাকায় আসেন। পরে একটি বিকাশের দোকানের সামনে তাদের সঙ্গে দেখা হয় শাকিল হোসেনের। শাকিল হোসেনের পরিবার ও পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছেন, বিকাশের এজেন্ট শাকিলের সঙ্গে ‘পরকীয়া সম্পর্ক’ চলছিল আসমার।
আসমা, রবিন ও শাকিলের সঙ্গে সৌমেন ঢুকে পড়েন একটি খাবার হোটেলে। সেখানে তাদের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। হোটেল মালিক এসময় তাদের অন্যত্র চলে যেতে বলেন। এরপর তারা সেখান থেকে বেরিয়ে পাশের একটি মসজিদের গলিতে যান। সেখানেও তাদের মধ্যে বাদানুবাদ চলতে থাকে। একপর্যায়ে সৌমেন তার অস্ত্র বের করে মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করবেন বলে হুমকি দিতে থাকেন। এরপর তিনি আসমা ও শাকিলের দিকে গুলি ছুঁড়তে থাকেন। দুইবার মিস ফায়ার হলে রবিন দৌঁড়ে পালাতে থাকেন। সে সময় সৌমেন পেছন থেকে গুলি ছুঁড়লে নিহত হয় রবিন।
এরপর শাকিল ও আসমাকে সৌমেন কাছ থেকে গুলি করে হত্যা করেন। তিনজনকে খুন করতে সৌমেন ১১ রাউন্ড গুলি খরচ করেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, যা পরে পুলিশও নিশ্চিত করেছে। এরপর ব্যবসায়ীরা একজোট হয়ে সৌমেনকে আটক করেন। এসময় পুলিশ এসে সৌমেনকে ধরে নিয়ে একটি বাড়িতে আটকে রাখে। ক্ষুব্ধ জনতা তাকে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে পুলিশের অতিরিক্ত সদস্যরা এসে তাকে থানায় নিয়ে যায়।
পুরো ঘটনাটি মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘটে বলে জানিয়েছেন ওই স্থানের দোকানদার মাসুদ সরদার। তিনি জানান, কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়কের কাস্টমস মোড় থেকে নেমে আসা ম আ রহিম সড়কের প্রথম বাড়ি নাজ ম্যানশন। এর বিপরীত দিকে প্রথম দোকানটি তার।
মাসুদ বলেন, ‘বেলা সোয়া ১১টার দিকে হবে, আমি তখন দোকানে কলা সাজাচ্ছিলাম। দেখলাম রাস্তার ওপারে দুজন পুরুষ, একজন মহিলা ও এক শিশু দাঁড়িয়ে কথা বলছেন। তারা সামনের খাবারের দোকানে বসতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দোকানি তাদের না করে দেন। এরপর তারা কথা বলতে বলতে ওই বিল্ডিংয়ের (নাজ ম্যানশন) নিচতলার কলাপসিবল গেটের ভেতরে চলে যান। সেখানেও দুই সারিতে দোকান রয়েছে। হঠাৎ তিনটি গুলির শব্দ শুনি। শুনি চিৎকার-চেঁচামেচি।’
তিনি আরো বলেন, ‘এর মধ্যে দেখি ওই শিশুটি দৌড়ে বের হয়ে আসল। সে ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। এ সময় বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যায়। এর সঙ্গে সঙ্গে পেছনে পিস্তল হাতে ছুটে আসেন একজন। তিনি শিশুটির মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে পরপর তিনটি গুলি করেন। এরপর আবার দ্রুত কলাপসিবল গেটের মধ্যে চলে যান।’
কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে আবাসিক মেডিকেল অফিসার তাপস কুমার সরকার বলেন, ‘নিহতদের মাথাসহ শরীরের অন্য স্থানে গুলি করা হয়েছে। খুব কাছ থেকে গুলি চালানো হয়েছে। কিন্তু কারও দেহের মধ্যে গুলি পাওয়া যায়নি। মরদেহগুলো হাসপাতালের মর্গে আছে।’
২০০৪ সালে পুলিশে কনস্টেবল পদে চাকরি পান সৌমেন। তার বাড়ি মাগুরা সদর উপজেলার বরইচারা গ্রামে। ২০১৭ সালে কুষ্টিয়ায় সৌমেনের পোস্টিং হয়। এরপর তিনি উপ-সহকারী পরিদর্শক (এএসআই) পদে পদোন্নতি লাভ করেন। এর মধ্যে আসমার সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তখন সৌমেন কুষ্টিয়ার মিরপুর, ইবি, কুমারখালী থানাসহ বেশ কয়েকটি ক্যাম্পে দায়িত্ব পালন করেন।
এর আগে সৌমেন ২০০৫ সালে আথি রায় নামে এক নারীকে বিয়ে করেন। সেই ঘরে তার এক মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। তারা খুলনায় বসবাস করে। সৌমেনের সঙ্গে বিয়ের আগে আসমার আরও দুটি বিয়ে হয়। প্রথম ঘরে এক মেয়ে ও দ্বিতীয় ঘরে রবিনের জন্ম হয়। আসমা পরে হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করে আঁখি নাম ধারণ করেন।
আসমার গ্রামের বাড়ি বাগুলাটের নাতুড়িয়া গিয়ে কথা বলে প্রতিবেশিরা জানান, এলাকায় তারা থাকেন না। পরিবারসহ কুষ্টিয়ায় আমলাপাড়ায় ভাড়া থাকেন।
পুলিশের ওই সূত্র জানায়, এরপর আখিকে সে শহরে বাসা ভাড়া করে দেয়। মাঝেমধ্যে সে এসে তাদের সাথে থাকতো।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর সৌমেন রায় পুলিশকে যে তথ্য দিয়েছেন, তাতে শাকিলের সঙ্গে আসমার ‘পরকীয়ার সম্পর্কই’ এ খুনের প্রধান কারণ’ হতে পারে বলে ধারণা করছে কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ।
জেলা পুলিশের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে এ তথ্য দিয়েছেন। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এ বিষয়ে কিছু বলছে না কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ।
কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘হত্যাকা-ের প্রাথমিক কারণ আমরা জানতে পারিনি। এ বিষয়ে তদন্ত করে পরে বিস্তারিত জানানো হবে।’
আসমার সঙ্গে বেশ কয়েকজন যুবকের সম্পর্ক চলছিল বলে পুলিশকে জানিয়েছেন সৌমেন। বিষয়টি জানতে পেরে সৌমেন কললিস্টসহ বিভিন্ন প্রমাণ সংগ্রহ করেন।
সর্বশেষ শাকিলের সঙ্গে আসমা ওরফে আঁখির সম্পর্ক চলছিল বলে সৌমেন নিশ্চিত হয়।
গত শনিবার সৌমেন আঁখিকে ফোন করে জানান, তাদের তিনি খুলনায় নিয়ে যাবেন। পরে কুষ্টিয়ায় এসে সৌমেন শাকিল প্রসঙ্গে আঁখির সঙ্গে তর্কে জড়ান।
কুষ্টিয়ার সাঁওতায় নিহত শাকিলের বাড়িতে গিয়ে কথা হয় তার মা মরিয়ম খাতুন ও ভাবি লতার সঙ্গে। তারা বলেন, ‘শাকিলের সঙ্গে আসমার চেনাজানা ছিল। আমরা জেনেছি, তাদের মধ্যে ভাইবোনের সম্পর্ক ছিল। এর বাইরে কোনো গোপন সম্পর্ক ছিল কি না, তা আমরা জানি না। একদিন আমাদের বাড়িতে সৌমেন আসেন। তিনি জানান গোপন সম্পর্কের কথা। শাকিল যেন আসমার সঙ্গে না মিশে, সে জন্য আমাদের বলে যায়।’
আসমার গ্রামের বাড়ি বাগুলাটের নাতুড়িয়া গ্রামে। তার প্রতিবেশীরা জানান, ‘আসমার পরিবারের কেউ গ্রামে থাকে না। তারা কুষ্টিয়াতে ভাড়া বাসায় চলে গেছেন।’
কুষ্টিয়ার আমলাপাড়ায় আসমাদের বাসাতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। হাসপাতালেও আসেননি কেউ।