এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
একটি খবর ও ভিডিও সারদেশে চাউর হয়ে উঠেছে। দুই শিশু পুত্রকে আগ্নেয়াস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন বিচারক পিতা। তিনি বর্তমানে চাঁপাইনবাবগঞ্জে জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি নিয়ে যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক চলছে। সরগম হয়ে উঠেছে চায়ের দোকান থেকে খোদ সুধী মহলে। সন্দেহ নেই আরো কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক। যাঁরা বিচারকের আসনে অধিষ্ঠিত, তাঁদের অন্যায়, অনিয়মের বিচার করবে কে?
৬ মিনিট ৩৫ সেকেন্ডের ভিডিওটিতে দেখা যাচ্ছে, বনের ভেতর দুই শিশু পুত্রকে একটি পিস্তল চালনা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন পিতা। নদীর ধার ঘেষে বনের বিভিন্ন স্থানে কয়েক দফা দুই সন্তানকে নিজে অস্ত্র চালানা প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এ সময় একজন সকল কর্মকাণ্ড ভিডিও করছিলেন। এ সময় দেখা যায়, পিস্তল হাতে শিশুপুত্র। পেছনে দাঁড়িয়ে বিচারক পিতা। তিনি ছেলেকে শেখাচ্ছেন ট্রিগার চাপার কৌশল। ছেলেও একের পর এক ছুড়ছেন গুলি। প্রচন্ড রকমের বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে চারপাশ। যদিও এ ভিডিওটি বিচারক নিজেই তার ফেসবুকে আপলোড দিয়েছিলেন ২০১৬ সালে। সে সময় তিনি নাকি সুন্দরবনে ছিলেন। তখন বাচ্চারা শখ করে এক/দুই দিন করেছে। তাঁর ভাষায় কোনো খারাপ উদ্দেশ্যে নয়, এই ধরেন গাছকে এইম করে গুলি করা এই আরকি। তিনি গণমাধ্যমকে আরও জানিয়েছেন, ডিউটিকালীন সময়ে ঘুমিয়ে গেলে তার সহকর্মীরা পিস্তল নিয়ে ডিউটি করত, এটা কোনো অপরাধ নয়। কয়রায় ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন সুন্দরবনের বনদস্যু ও ডাকাতদের হটাতে নাকি গুলি চালাতে হত। যদিও ডাকাতদের হঠাতে গুলি চালিয়েছেন তার দুটি মাসুম বাচ্চা। এখন নতুন করে ভিডিওটি ভাইরাল হওয়া বিষয়ে তিনি বলছেন এ ঘটনায় পারিবারিক লোকজন জড়িত। পারিবারিক দ্বন্ধ থেকেই নিয়াজ মাহমুদ নামে একজন নাকি ওই বিচারককে বিপাকে ফেলতে ভিডিওটি নতুন করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন। তিনি আরও জানিয়েছেন বন্ধুবান্ধবরা মিলে এমনি নাকি ফায়ার দিতেন। একটা গাছ টার্গেট করে ফায়ার দিতেন, তাঁর যেহেতু অস্ত্র আছে দুইটা, তাঁর ওয়াইফ ও তার ছেলেমেয়েরা একটু শিখত। শ্যুটিং একটা স্পোর্টস। এরা এখন থেকে শিখলে এটা ঠিক হবে, এটুকুই। অবম্য তিনি জানিয়েছেন, এটা বাচ্চারা শখ করে করেছে। তবে এটা করা ঠিক হয়নি। সেজন্য তিনি দুঃখ প্রকাশও করেছেন।
আমরা ইতিহাস থেকে জেনেছি, দুর্গম ও পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী খাসি জাতি দূর অতীতে তাদের নিজস্ব কৌশল ও পদ্ধতিতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরি করত এবং তারা এসব অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মাতৃভূমি রক্ষার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। বন পাহারা এবং মূল্যবান বনজ সম্পদ ও গাছ রক্ষার কাজেও লাইসেন্সকৃত অস্ত্রের ব্যবহার হয়। কিন্তু সেই গাছকে এইম করে কেউ গুলি চালায় শখের বসে, তখন প্রান নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাছটি বিচার দিবে কার কাছে?
আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স নীতিমালা অনুযায়ী, লাইসেন্সকৃত অস্ত্র আত্মরক্ষার জন্য ব্যবহার করা যায়। অন্য কোন ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় না। কারন লাইসেন্সটা দেওয়া হয় শুধুমাত্র ব্যক্তির নিরাপত্তার জন্য। শখের বসে কিংবা বউ-সন্তানদের অস্ত্রের ব্যবহার শেখানো, সেগুলো ভিডিও করে সবাইকে জানান দেয়ার জন্য নয়।
ব্রিটিশ শাসন আমলে প্রবর্তিত আইন অনুসারে আগ্নেয়াস্ত্র লাইসেন্স প্রদানের উদ্দেশ্য আত্মরক্ষা, জানমালের নিরাপত্তা এবং ক্রীড়াক্ষেত্রে ব্যবহার। আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স প্রদানের ক্ষেত্রে অস্ত্র চালনায় দক্ষতা থেকে শুরু করে অস্ত্র রাখা বা সংরক্ষণের সামর্থ্য, সামাজিক অবস্থান ইত্যাদি বিবেচনার পাশাপাশি লাইসেন্সধারীর নিরাপত্তা ঝুঁকির বিষয়টি সর্বাগ্রে বিবেচনায় আনা হয়। বস্তুত, ব্যক্তি বা জনগণের নিরাপত্তা প্রদানের দায়িত্ব রাষ্ট্রের, সেই দায়িত্বের অংশ হিসেবে জনগণের বা ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধানকল্পে আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স দেওয়া হয়।
এবার আসি সন্তানদের নৈতিক শিক্ষা সম্পর্কে। হজরত নুহ (আ.) বলেছিলেন, ‘হে আমার রব! পৃথিবীতে অকৃতজ্ঞদের একটি গৃহও রেখো না। যদি তুমি তাদের ছেড়ে দাও, তবে তারা তোমার বান্দাদের বিপথগামী করবে এবং তারা অপরাধী ও পাপী সন্তানই জন্ম দেবে।’ (সুরা-৭১ নুহ, আয়াত: ২৬-২৭)। তাই আমাদের মানবসভ্যতার রক্ষার জন্য শিশুদের শৈশবকে পঙ্কিলতা ও আবিলতামুক্ত রাখতে হবে। সভ্যতার উন্নয়নের জন্য আমাদের শিশুদের উন্নত চিন্তা ও পবিত্র জীবনের দীক্ষা দিতে হবে। নতুবা তারা হবে ডিপজল।
কোনো শিশু যদি অভিভাবকের কারণে পথচ্যূত হয়ে যায়, তাহলে সে হাশরের দিনে আল্লাহর কাছে সেই অভিভাবকের বিরুদ্ধে ফরিয়াদ করবে, ‘হে আমাদের রব! আমরা আমাদের অভিভাবক ও বড়দের অনুসরণ করেছি, তারা আমাদের বিপথগামী করেছে। হে আমাদের প্রভু! আপনি তাদের দ্বিগুণ শাস্তি দিন এবং মহা অভিসম্পাত করুন।’ (সুরা-৩৩ আহজাব, আয়াত: ৬৭-৬৮)। তারা আরও বলবে, ‘হে আমাদের প্রভু! যে সকল জিন ও ইনসান আমাদের বিপথগামী করেছে, তাদেরকে আমাদের সামনে আনয়ন করে প্রকাশ করুন। আমরা তাদিগকে আমাদের পদতলে পিষ্ট করব, যাতে তারা হীন লাঞ্ছিত অপমানিত হয়।’ (সুরা ৪১ হা-মিম আস সাজদাহ, আয়াত: ২৯)।
তাই আসুন, শিশুকে অস্ত্র শিক্ষা নয়, শিশুর নৈতিক শিক্ষার সব ব্যবস্থা করি, যাতে তার দুনিয়া ও আখিরাত মঙ্গলময় হয়। শিশুকে ভালো মন্দ, ন্যায় অন্যায়, কল্যাণ ও অকল্যাণ বোঝাতে হবে, যাতে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আসুন, আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এহেন ঘটনায় একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন, যাতে ভবিষ্যতে এরকম ঘটনার পূণরাবৃত্তি না ঘটে।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, ফ্রি-ল্যান্স কলামিস্ট ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ই-মেইলঃseraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com