বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৫৫ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
ব্যাংক বা যে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গ্রাহকের মৃত্যুর পর মনোনীত নমিনিই পাবেন জমাকৃত টাকা। নমিনি ব্যতিত অন্য কাউকে জমানো অর্থ পাওয়ার সুযোগ নেই বলে পূর্নাঙ্গ রায় দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট। ২৩ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এ রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, নমিনি সংক্রান্ত আইন, বিধি-বিধান মেনে যদি কোথাও নমিনি থাকে তাহলে আমানতকারী, বন্ডধারী, শেয়ারহোল্ডার, পেনশনধারী ইত্যাদি ব্যক্তির মৃত্যুর পর সংশ্লিষ্ট নমিনি আমানতকৃত সকল অর্থ বা অন্যান্য সুবিধাদির অধিকারী হবেন। ৭৩ ডিএলআর, এপ্রিল ২০২১ ইস্যুতে উল্লেখ করা হয়েছে, বিদ্যমান সকল আইন ও বিধিবিধান অনুযায়ী আমানতকারীর মৃত্যুর পর নমিনিকৃত আমানত বা সুবিধাদি গ্রহণে নমিনিই অধিকারী হবেন এবং অন্যান্য সকল ব্যক্তি এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন। হাইকোর্ট রায়ে আরো উল্লেখ করেছেন, ব্যাংক কোম্পানী আইন, ১৯৯১ অনুযায়ী নমিনিকে তার পাওনা বুঝিয়ে দেয়া ব্যাংকের দায়িত্ব। পাওনা বিতরন করা হয়ে গেলে ব্যাংক তার দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে যায়। জমাকৃত অর্থের বিষয়ে কোনো বিরোধ কিংবা কোনো ব্যক্তির কোনোরূপ দাবী বিষয়ে ব্যাংকের কিছুই করণীয় নেই। কোনোরূপ মামলা-মোকদ্দমাকে আমন্ত্রন জানানো কিংবা মৃতের অর্থ বা সম্পদ বিষয়ে কোনো ব্যক্তির দাবী উপস্থাপনের জন্য ব্যাংকের অপেক্ষা করা উচিত নয়। যদি কারো কোনো দাবী থেকে থাকে তাহলে সেটা উপযুক্ত ফোরামে সমাধানের দায়িত্ব নমিনির, যিনি অর্থ গ্রহণ করেছেন।
মাননীয় হাইকোর্ট আরও বলেছেন নমিনি পদ্ধতিটা বৈধ এবং নমিনী পদ্ধতিটাই থাকবে। ব্যাংক কোম্পানী আইন ১৯৯১, ইন্স্যুরেন্স অ্যাক্ট, গভর্নমেন্ট সেভিং ব্যাংকস অ্যাক্ট ১৮৭৩, পোস্ট অফিস ন্যাশনাল সেভিংস সার্টিফিকেট অধ্যাদেশ ১৯৪৪, ইন্স্যুরেন্স অ্যাক্ট ২০১০, কো-অপারেটিভ সোসাইটিস অ্যাক্ট ২০০১, পেনশন সহজীকরন বিধিমালাসহ পার্লামেন্ট কর্তৃক পাশ করা বহু আইন আছে যেখানে বলা আছে আমানতকারীর ইচ্ছা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট নমিনি এই অর্থ বা সুবিধা পাবেন। এই ধরনের কোনো আইন বা এর কোনো অংশকে কোনো মামলায় কখনো অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হয়নি।
উল্লেখ্য, দেশের সকল সরকারী চাকুরী এমনকি প্রভিডেন্ট ফান্ড সিস্টেম আছে এমন বেসরকারী অফিস, ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান, রিয়েল এস্টেট কোম্পানী, আইনজীবী সমিতিসহ প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে নমিনি ফর্ম পূরণ করা বাধ্যতামূলক। তবে আমানতকারীগণ যেকোন সময় মনোনীত ব্যক্তির মনোনয়ন বাতিলপূর্বক অন্য কোন ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে মনোনীত করতে পারবেন। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, নমিনি নাবালক থাকলে উক্ত একক আমানতকারীর বা যৌথ আমানতকারীগণের মৃত্যুর ক্ষেত্রে আমানতের টাকা কে গ্রহণ করবে সে সম্পর্কে উক্ত একক আমানতকারী বা যৌথ আমানতকারীগণ নির্দিষ্ট করে দিতে পারবেন। নমিনি কীভাবে হবে বা আমানতকারীর মৃত্যুর পর আমানতের সুবিধা কীভাবে নমিনিই পাবে তা ব্যাংক কোম্পানি আইন ১৯৯১ (২০১৩ পর্যন্ত সংশোধিত) এর ১০৩ ধারায় স্পষ্ট করে বলা আছে। ব্যাংক কোম্পানির কাছে রাখা কোনো আমানত যদি একক ব্যক্তি বা যৌথভাবে একাধিক ব্যক্তির নামে জমা থাকে, তাহলে ওই একক আমানতকারী এককভাবে বা ক্ষেত্রমতে যৌথ আমানতকারীরা যৌথভাবে নির্ধারিত পদ্ধতিতে এমন ব্যক্তিকে মনোনীত করতে পারবেন, যাকে আমানতকারীর মৃত্যুর পর অর্থ দেওয়া যেতে পারে।
তবে আমানতকারী চাইলে যেকোনো সময় নমিনি পরিবর্তন করতে পারবে। একটি ঘটনার বিবরণে জানা যায়, ২০১৪ সালের মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি ডিরেক্টর শহিদুল হক চৌধুরী তার দ্বিতীয় স্ত্রীকে নমিনি করে ৩০ লক্ষ টাকার সঞ্চয়পত্র রাখে। পরে শহিদুল হক মারা গেলে তার দ্বিতীয় স্ত্রী পুরো টাকা একাই ভোগ করতে চাইলে মৃত শহীদুলের প্রথম পক্ষের সন্তানরা টাকা দাবি করে মামলা করে। তবে নিম্ন আদালত রায় দেন, নমিনি যে সেই টাকা পাবে। এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে ২০১৬ সালে এপ্রিল মাসে মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে থাকা টাকা নমিনি নয়, উত্তরাধিকারীরা পাবেন বলেন রায় দেন আদালত। তবে আপিল বিভাগে গিয়ে রায়টি আটকে যায়। অবশেষে সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে মৃত ব্যক্তির ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা পাবে নমিনি, উত্তরাধিকার নয়! মর্মে রায় দিয়ে সকল বিবাদের অবসান ঘটিয়েছেন।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮