বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০২ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
খতিয়ান হচ্ছে জমির পরিচিতির এক প্রকার দলিল যা খতিয়ান স্বত্বলিপি, রেকর্ড অব রাইটস ও পর্চা নামেও পরিচিত। জমির মালিকানা নির্ধারণ, জমির পরিচিতি, ভূমি উন্নয়ন কর আদায়, জমি সম্পর্কে তথ্য ইত্যাদির জন্য পরচা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই খতিয়ান মাঠ পর্যায়ে একেবারে হাতে কলমে জরিপের মাধ্যমে তৈরি করা হয়। জরিপের সময় কোন উপজেলার জমি ছোট ছোট ভাগ করে জরিপ করা হয়। এই ছোট ছোট ভাগকে মৌজা বলে। মৌজাকে অংকে একটি নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, যাকে মৌজা নম্বর বলে। মৌজা নম্বর জে এল নম্বর জুরিসডিকশন লিস্ট নম্বর নামেও পরিচিতি। মৌজাকে আবার প্লটে ভাগ করে প্লট নম্বর দেয়া হয়। কোন মৌজার উত্তর পশ্চিম কোণ থেকে প্লট নম্বর দেয়া শুরু করা হয় এবং দক্ষিণ পূর্ব কোণে গিয়ে শেষ করা হয়। কোন মালিক বা মালিকগণের একাধিক প্লট থাকতে পারে। সম্পূর্ণ বা আংশিক এক বা একাধিক প্লট দিয়ে একটি খতিয়ান খোলা হয়।
এবার জেনে নিই একটি খতিয়ানে সাধারণতঃ যেসব তথ্য থাকে। একটি খতিয়ানে কোনো মৌজার এক বা একাধিক দাগ, এক বা একাধিক জমির মালিকের নাম, পিতার নাম, ঠিকানা থাকতে পারে। প্রত্যেক মালিকের প্রাপ্য অংশ, জমির পরিমাণ, জমির শ্রেণী, পথাধিকার ও সুখাধিকার, ভূমি উন্নয়ন করের পরিমাণ ইত্যাদি তথ্য খতিয়ানে উল্লেখ থাকে। তবে ১৯৭৬ সালে ভূমি উন্নয়ন কর অধ্যাদেশ জারি হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত খতিয়ানে লেখা ভূমি উন্নয়ন করের পরিমাণ ব্যবহার করা হতো। এই আইন জারি হওয়ার পর খতিয়ানে আর ভূমি উন্নয়ন করের পরিমাণ লেখা হয় না।
এবার জেনে নিই খতিয়ানের প্রকারভেদ ও বর্ণনা সম্পর্কে। খতিয়ান প্রধানতঃ দুই ভাগে ভাগ করা যায় । জরিপ খতিয়ান ও মিউটেশন খতিয়ান। জরিপ খতিয়ানকে আবার সিএস বা ডিএস, এম আর আর বা এসএ, বিএস, আরএস, পেটি ইত্যাদিতে ভাগ করা হয়ে থাকে। আর মিউটেশন খতিয়ান হচ্ছে মিউটেশনের মাধ্যমে যে খতিয়ানের সৃষ্টি করা হয়। আমরা সবাই জানি জরিপের মাধ্যমে খতিয়ান সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু জরিপের পর বিক্রি, এওয়াজ-বদল, দান, হেবা, ওয়াকফ্, দেবোত্তর, অধিগ্রহণ, মালিকের মৃত্যু ইত্যাদি কারণে মালিকানা প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হয়। সেকারণ মিউটেশনের মাধ্যমে খতিয়ানে পরিবর্তন এনে দুই জরিপের মধ্যবর্তী সময়ের মালিকানা পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটানো হয়।
এবার জেনে নিই সিএস খতিয়ান সম্পর্কে। সিএস খতিয়ান ১৮৮২ সালের বেঙ্গল টেন্যান্সী এ্যাক্ট বলে তৈরি করা হয়। এর আগে কোন পরিবার ভিত্তিক লিখিত খতিয়ান ছিল না। সিএস এর মতো পরিকল্পিত জরিপও ছিলো না। তাই সিএস জরিপকে আজ পর্যন্ত সর্বাধিক সঠিক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সিএস খতিয়ানে তৌজি নম্বর, জমিদারের নাম থাকতো এবং জমিদারের অধীনে রায়তের নাম, জমির পরিমাণ, খাজনার পরিমাণ ইত্যাদি উল্লেখ থাকতো। সিএস খতিয়ান চেনার আরও একটা উপায় হলো-এটি কাগজে লম্বালম্বিভাবে লেখা। এসএ খতিয়ান আড়াআড়িভাবে লেখা।
এবার জেনে নিই এম আর আর বা এস এ খতিয়ান সম্পর্কে। ১৯৫০ সালের আগে আমাদের দেশে জমির মালিক ছিল জমিদাররা। কৃষকরা জমিদারদের কাছ থেকে এখনকার লিজের মত জমি বন্দোবস্ত নিয়ে চাষাবাদ করতো। ১৯৫০ সালে জমিদারী প্রথা বাতিল হয়ে গেলে যারা চাষ করতো, তাদেরকে জমির মালিকানা দেয়া হয়। তাই জমিদারের নামের পরিবর্তে খতিয়ানে প্রজার বা চাষীর নাম লেখার প্রয়োজন হয়। সে জন্য স্টেট একুইজিশন এ্যান্ড টেন্যান্সি এ্যাক্ট, ১৯৫০ নামের আইন জারি করা হয়, যা এসএ এ্যান্ড টি এ্যাক্ট নামে পরিচিত। তাই এই খতিয়ানকে এসএ খতিয়ান বলে। এই আইনবলে জমিদারের নাম পরিবর্তন করে প্রজা বা মালিকের নাম অন্তর্ভূক্ত করে খতিয়ান তৈরি করা হয়। এই কাজ ১৯৫৬ সাল থেকে শুরু করে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন এলাকায় চলতে থাকে।
এবার আসি আর এস খতিয়ান বিষয়ে। সিএস জরিপের পর অনেক বছর অতিবাহিত হওয়ার পর মালিকানা ও প্লটের ব্যাপক পরিবর্তন হওয়ায় পুনরায় জরিপের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই ১৯৬৫ সাল হতে ঢাকা ও রাজশাহী জেলায় আর এস জরিপ শুরু করা হয়।
এবার জেনে নিই এতক্ষণ যে খতিয়ান বিষয়ে আলোচনা করলাম এগুলো কোথায় পাবেন। খতিয়ানের নকল পাবার জন্য নিজ নিজ জেলার রেকর্ড রুমের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার কাছে দরখাস্ত করতে হয়। এক দরখাস্তে চারটির বেশি খতিয়ানের নকল পাওয়া যায় না। নকল পাবার দরখাস্তের সাথে ২০ টাকার কোর্ট ফি দিতে হয়। সাধারণ আবেদনে ৭২ ঘণ্টা পর নকল পাবার কথা কিন্তু বাস্তবে অনেক দেরি হয়।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ইমেইল: seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮