রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:৩২ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
স্ত্রী যেমন স্বামীর বিরুদ্ধে যৌতুকের মামলা করতে পারে, ঠিক তেমনি স্বামীও যদি স্ত্রীর কাছ থেকে যৌতুক কিংবা নির্যাতনের শিকার হন তাহলে তিনিও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও যৌতুকের মামলা করতে পারবেন। এতে আইনে কোথাও বাধা নেই।
স্বামীর কাছে গাড়ি-বাড়ি যৌতুক চাওয়ায় স্ত্রীর বিরুদ্ধে যৌতুক মামলা ও তার ফলাফল নিয়ে শুনুন একটি বাস্তব কেইস ষ্টাডি। কুষ্টিয়ার হরিশংকরপুর গ্রামের সজীব হাসানের সাথে বছর তিনেক আগে নাজমুন নাহারের বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছরের মাথায় তাদের ঘরে আসে ফুটফুটে একটি কন্যা সন্তান। বিয়ে মানুষের জীবনে সুখকর অনুভূতির জন্ম দিলেও কখনও কখনও তা অভিশাপ রুপে দেখা দেয়। নাজমুন নাহার নিজের ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত হয়ে উঠে। সজীবের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করে টাকা অথবা সেখানে বিল্ডিং বানিয়ে দেয়া অথবা একটি ফ্ল্যাট কিনে দেয়ার দাবিতে নির্যাতন শুরু করে নাজমুন। নিজের সীমাবদ্ধতার কথা জানালে স্ত্রী নাজমুন তাকে বিভিন্ন সময় চড়, থাপ্পড়, কিল-ঘুষিসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতন করতে থাকে। সামাজিক সম্মানের ভয়ে তিনি এসব কাউকে প্রকাশ না করে মুখ বুজে সংসার করতে থাকে। কিন্তু নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় তিনি অবশেষে স্ত্রীর বিরুদ্ধে যৌতুক চেয়ে না পেয়ে স্বামীকে নির্যাতন করায় মামলা দায়ের করেন। বিজ্ঞ আদালত ২০১৮ সালের যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারায় অভিযোগ গ্রহণ করে স্ত্রীকে হাজিরের জন্য সমন জারি করেন।
যৌতুকের শিকার হলে যে কোন পক্ষ স্বামী অথবা স্ত্রী মামলা দায়ের করতে পারেন। কোনো পক্ষ তার কাবিননামাসহ বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে গিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে সরাসরি এ মামলা করতে হয়। মারধরের শিকার হলে চিকিৎসা সনদ সহকারে মামলা করা উচিত, না হলে মামলা প্রমাণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। বিয়ের সময় কাবিননামা নিজের সংগ্রহে রাখতে হবে। কারণ কাবিননামা ছাড়া এ মামলা করা সম্ভব হবে না। যৌতুকের মিথ্যা মামলা করলে মিথ্যা মামলাকারীকে শাস্তি পেতে হবে। ‘যৌতুক নিরোধ আইনের ৬ ধারায় বলা হয়েছে, যদি আপনার স্ত্রী কিংবা স্বামীর পরিবারের কেউ আপনাকে ক্ষতিসাধনের ইচ্ছায় মিথ্যা যৌতুকের মামলা করেন কিংবা মামলা করাতে সহায়তা করেন, তাহলে তিনি বা তারা ৫ বছরের কারাদÐ বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দÐে দÐিত হবেন। তবে এ মামলাটি করতে হবে যখন আপনি মিথ্যা মামলার দায় থেকে বেকসুর খালাস পাবেন। যৌতুক নেওয়া শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যে নিবে বা যারা দিবে তাদের সবারই সাজা হবে। এ জন্য যৌতুক নেওয়ার অপরাধকে বলা হয়েছে জামিন অযোগ্য। যৌতুক নেওয়ার জন্য শাস্তি হবে ১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড বা ৫০০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দন্ডই হতে পারে। ২০১৮ সালে পাস হওয়া যৌতুক নিরোধ আইনে এ কথাগুলো বলা আছে।
আমাদের জেনে রাখা দরকার, যে ব্যক্তি যৌতুক নেওয়ার ব্যাপারে সহায়তা করবে তাদেরও একই রকম শাস্তি হবে এবং যে ব্যক্তি যৌতুক দাবি করবে তারও একই রকম শাস্তি হবে। এ ছাড়া যৌতুক গ্রহণের জন্য যদি কেউ উদ্বুদ্ধ করে বা প্ররোচিত করে বা উৎসাহিত করে সেই ব্যক্তিও যৌতুক নিরোধ আইনের তিন ধারা অনুযায়ী অপরাধী হবে এবং তার শাস্তি হবে।
একটি জীবন্ত কেস ষ্টাডি দিয়েই আলোচনাটি শেষ করতে চাই। যৌতুক হিসেবে পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে স্ত্রী ও তার পিতা-মাতা। দাবি করা টাকা দেওয়া না হলে মেয়েকে অন্যত্র বিয়ে দেওয়ার হুমকিও দেন তারা। স্ত্রী উর্মীকে সংসারে ফিরে আসার অনুরোধ জানায় স্বামী সামছুর রহমান। তবে টাকা না পেলে সংসারে ফিরবে না বলে জানিয়ে দেয় উর্মী। মামলাটিতে প্রথমে পুলিশি তদন্ত এবং পরে বিচার বিভাগীয় তদন্ত অনুষ্ঠিত হয়। বিচার বিভাগীয় তদন্তে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে উর্মির বাবা-মাকে বাদ দিয়ে শুধু উর্মির বিরুদ্ধে মামলাটি আমলে নেন আদালত। পরে উর্মিকে আদালতে তলব করা হলে তিনি আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন। এরপর উর্মির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন। এ মামলার বিচারকালে বাদী পক্ষে পাঁচজন এবং বিবাদী পক্ষে দুই জনের সাফাই সাক্ষ্য নেন বিচারক। বিচারিক রায়ে স্ত্রীকে জেল ও জরিমানা করা হয়। এ রায়ের মধ্য দিয়ে নারীর হাতে পুরুষ নির্যাতন বা স্ত্রীর হাতে স্বামী নির্যাতনের সত্যতা প্রকাশ পায়।
লেখকঃ আইনজীবী বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮