শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৭ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
আপনি অপমানের শিকার শিকার হয়েছেন, কেউ আপনাকে মানহানি করেছেন, আপনার সম্পর্কে আজেবাজে মন্তব্য করে বেড়াচ্ছে, কুৎসা রটনা করে বেড়াচ্ছে, ফেসবুকে, সংবাদপত্রে কিংবা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কুৎসা রটনা করে আপনাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করে চলেছেন। নো টেনশন। আপনি কুৎসা রটনাকারী ও অপমানকারীদের বিরুদ্ধে আইনী ব্যবস্থা নিতে পারেন। শাস্তির ব্যবস্থা করতে পারেন কিংবা ক্ষতিপূরণ আদায় করতে পারেন। কীভাবে আইনি প্রতিকার পাবেন, এর জন্য কোথায় যেতে হবে, কি মামলা করতে হবে, কত টাকা খরচ হবে-এসব আইনী দিক, সমস্যা ও সমাধান নিয়ে আইনী আলোচনা জানুন।
আপনি মানহানির অভিযোগ এনে ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয়বিধ মামলা করতেই পারেন। দ-বিধির ৪৯৯, ৫০০,৫০১ ও ৫০২ ধারায় মানহানি কিসে হবে আর কিসে হবে না-সে সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ রয়েছে। কাজেই আপনি ফৌজদারি আদালতে মানহানির মামলা করলে আদালত অভিযোগ শুনে আসামীর বিরুদ্ধে সমন জারি করতে পারেন। সমন দেওয়ার পর যদি কোনো ব্যক্তি আদালতে হাজির না হন, সে ক্ষেত্রে বিচারক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করতে পারেন। দ-বিধির ৪৯৯ ধারায় বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে উদ্দেশ্যমূলকভাবে শব্দাবলি বা চিহ্নাদি বা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এমনভাবে কোনো নিন্দা প্রণয়ন বা প্রকাশ করে, তাহলে ওই ব্যক্তির মানহানি করেছে বলে ধরা হবে। এমনকি মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে বললেও তা মানহানি হবে।
মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন মানহানির অভিযোগ আনতে পারবেন। তবে আইনে এমন কিছু ব্যতিক্রম অবস্থা বর্ণনা করা হয়েছে, যখন কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির নামে মানহানিকর কিছু বললে, লিখলে বা প্রচার করলেও মানহানি হবে না। যেমন: ১. জনগণের কল্যাণে কারও প্রতি সত্য দোষারোপ করলে মানহানি হবে না। ২. সরকারি কর্মচারীর সরকারি আচরণ সম্পর্কে সৎ বিশ্বাসে অভিমত প্রকাশ করলে তা মানহানির শামিল হবে না। ৩. সরকারি বিষয়-সংশ্লিষ্ট প্রশ্নে কোনো ব্যক্তির আচরণ নিয়ে মত প্রকাশ করলে মানহানি নয়। ৪. আদালতসমূহের কার্যবিবরণী প্রতিবেদন প্রকাশ করা মানহানির অন্তর্ভুক্ত হবে না। ৫. যেকোনো জনসমস্যা সম্পর্কে ও কোনো ব্যক্তির আচরণ সম্পর্কে সৎ বিশ্বাসে অভিমত প্রকাশ করা মানহানির শামিল নয়। ৬. আদালতে সিদ্ধান্তকৃত মামলার দোষ, গুণ বা সাক্ষীদের সম্পর্কে বা অন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের আচরণ সম্পর্কে অভিমত মানহানির পর্যায়ে পড়বে না। ৭. গণ-অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানাদি সম্পর্কে কোনো মতামত দেওয়া মানহানি নয়। ৮. কর্তৃত্বসম্পন্ন ব্যক্তির কাছে সৎ বিশ্বাসে কারো সম্পর্কে অভিযোগ করা হলে সেটিও মানহানি হবে না। যেমন: পুলিশের কাছে কারো ব্যাপারে সৎ বিশ্বাসে অভিযোগ। ৯. কোনো ব্যক্তি কর্তৃক তার বা অন্য কারো স্বার্থ রক্ষার্থে দোষারোপ করা মানহানি নয়। ১০. জনকল্যাণার্থে সতর্কতা প্রদানের উদ্দেশ্যে কারো সম্পর্কে কিছু বলা হলে মানহানি হবে না।
আর দ-বিধির ৫০০ ধারায় মানহানির শাস্তি বর্ণনায় বলা হয়েছে, এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদ- বা অর্থদ- বা উভয়বিধ দ- হতে পারে। অন্যদিকে দ-বিধির ৫০১ ও ৫০২ ধারা অনুসারে, মানহানিকর বলে পরিচিত বিষয় মুদ্রণ বা খোদাইকরণ সম্পর্কে এবং এর শাস্তি বর্ণিত হয়েছে।
মানহানিকর বক্তব্য যদি অনলাইনের বাইরে হয় তাহলে এক ধরনের শাস্তি আর অনলাইনে হলে আরেক ধরনের শাস্তি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৯ ধারার অধীনে মামলা করা হলে এবং মানহানিকর কোনও তথ্য-উপাত্ত প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য ৩ (তিন) বছরের কারাদ- ও ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে অবশ্যই মানহানিটা ডিজিটাল স্পর্শে হতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি পুনরায় একই অপরাধ করেন তবে ৫ (পাঁচ) বছরের কারাদ- ও ১০ (দশ) লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ে দন্ডিত হবেন।
এখন জানার বিষয়, কে মানহানি মামলা করতে পারেন। সহজ উত্তর ফৌজদারী কার্যবিধির ১৯৮ ধারা অনুসারে, মানহানির মামলা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ করলে আদালত তা আমলে নিবেন না। তবে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মহিলা হলে সেক্ষেত্রে আদালতের অনুমতি নিয়ে অন্য কেউ মামলা করতে পারেন যদি-উক্ত মহিলা দেশের রীতিনীতি ও প্রথানুসারে জনসমক্ষে হাজির হতে বাধ্য করা উচিত হবে না। উক্ত মহিলার বয়স ১৮ বছরের নীচে বা উন্মাদ বা আহাম্মক বা পীড়া বা অক্ষমতারকারণে নালিশ করতে অসমর্থ। যেমন স্ত্রীর ক্ষেত্রে স্বামী মামলা করতে পারেন। উক্ত ধারার রুলিং অনুযায়ী, কুৎসাজনক অপবাদগ্রস্থ কন্য বা কন্যারা তার পিতামাতার সাথে বসবাস করলে উক্ত পিতামাতা ১৯৮ ধারা অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত হবেন এবং কন্যার জন্য পিতা বা মাতা মামলা করতে পারেন। কারণ কন্যার অপমানে পিতা বা মাতা ক্ষুদ্ধ হবার কারণ থাকে।
আর দেওয়ানী আদালতে মামলা করা হলে এবং বাদিপক্ষ মানহানি হয়েছে তা প্রমাণ করতে পারলে বিবাদীপক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ আদায় করতে পারেন। তবে কোন ব্যক্তির মানসম্মানের মূল্য অর্থ দ্বারা পরিমাপ করা না গেলেও মানহানিকর উক্তি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তি বিভিন্ন অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দাবি করে দেওয়ানি প্রতিকার চাইতে পারেন। দেওয়ানী কার্যবিধির অধিনে মানহানির মামলা করলে কত টাকার মামলা করা যাবে তা নির্ভর করবে বাদীর সামাজিক মান মর্যাদার উপর। বাদীপক্ষযদি মানহানির ক্ষতিপূরণের জন্য ১ কোটি টাকা দাবি করে তাহলে বাদী পক্ষকে মামলার আর্জির সাথে প্রায় অর্ধ লক্ষ (৫০ হাজার) টাকা কোর্ট ফি জমা দিয়ে মামলা দায়ের করতে হবে। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে মামলার মূল্যমানের ওপর কোর্ট ফি নির্ভর করে। কোর্ট ফি এক ধরনের প্রত্যক্ষ কর।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮