বুধবার, ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০০ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
স্ত্রী যদি কোনো কারণে স্বামীর কাছে তালাক চান আর স্ত্রীকে যদি বিবাহের সময় কাবিননামার ১৮ নম্বর কলামে স্বামীকে তালাকের ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে কি না-প্রশ্নের উত্তরে যদি না থাকে, তাহলে স্ত্রীর উচিৎ স্বামীকে খোলা তালাকে রাজী করানো। স্বামী যদি স্ত্রীকে দেনমোহরের টাকা হতে বঞ্চিত করতেই চান এবং উভয়েই একে অপর থেকে বিচ্ছেদ চান, তাহলে তাদের জন্য রয়েছে খোলা তালাকের ব্যবস্থা। তবে এর জন্য কি করতে হবে, কোথায় যেতে হবে, কি কি আইনী পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে, খোলা তালাকের নিয়মাবলী কি, এর জন্য কত টাকা খরচ হবে-এ সম্পর্কিত আইনী আলোচনা, সমস্যা এবং সমাধান নিয়ে নিবন্ধটি পড়ুন।
আইনটা হচ্ছে স্ত্রীর যদি বিবাহের কাবিননামায় তার স্বামীকে তালাকের ক্ষমতা দেয়া না তাকে তাহলে স্ত্রীর পক্ষে স্বামীকে তালাক দিতে হলে পারিবারিক আদালতের মাধ্যমে তালাকের ডিক্রি নিয়ে তবে তালাক কার্যকর করতে হবে। মনে রাখতে হবে আদালতের এ প্রক্রিয়াটি কিন্তু সময়সাপেক্ষ, ব্যয়বহুল এবং কিছুটা জটিল ব্যাপারও বটে। সেকারণ মুসলিম আইনে খোলা তালাক নামে একটি পদ্ধতি আছে, যা দুজনের সম্মতিতে হয়ে থাকে।
তবে এ তালাকের উল্লেখযোগ্য দিক হলো-১। স্ত্রী স্বামীকে তালাক দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে থাকেন, ২। স্বামী ওই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে থাকেন, ৩। স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার সময় স্বামী বিনিময়ে স্ত্রীর কাছ থেকে প্রতিদান নিয়ে থাকেন এবং স্ত্রী তা দিয়ে থাকেন বা দিতে সম্মত হন।
তবে খোলা তালাকের ক্ষেত্রে অন্য কোনো চুক্তি না থাকলে স্ত্রী দেনমোহর পাওয়ার অধিকারী হবেন না; কিন্তু তিনমাস ইদ্দত পালনকালে স্ত্রী তাঁর গর্ভের সন্তানের জন্য স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন। খোলা তালা প্রস্তাবক যেহেতু স্ত্রী, তাই চেয়ারম্যানের কছে স্ত্রী নোটিশ পাঠাবে। যদি স্বামী বা স্ত্রী একত্রে শান্তি ও সৌহার্দের মধ্যে বসবাস করতে না পারে সেক্ষেত্রে স্ত্রী তালাকের বিনিময় মূল্য প্রদান করে খুলা তালাক পেতে অধিকারিণী। (শিরিন আলম চৌধুরী বনাম ক্যাপ্টেন শামসুল আলম চৌধুরী ৪৮ ডিএলআর, হাইকোর্ট, পৃষ্ঠা-৭৯)।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় একটি ভুল ধারণা রয়েছে যে, স্ত্রী যদি স্বেচ্ছায় কিংবা আগে স্বামীকে তালাকের নোটিশ দেন, তাহলে বুঝি দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে না। এটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। স্ত্রী আগে তালাক দিলেও তাঁর মোহরানা পরিশোধ করতে হবে। ব্যতিক্রম শুধু খোলা তালাকের ক্ষেত্রে। অনেক সময় স্ত্রী ঠিক বিচ্ছেদ না নিয়ে আলাদা বসবাস করতে চান। এ রকম হলেও আইনী বাঁধা নেই। বিশেষ করে হিন্দুধর্মের স্ত্রীরা অনেক সময় পৃথক থাকতে চান। যেহেতু বাংলাদেশে এখনো হিন্দুদের বিবাহবিচ্ছেদের কোনো বিধান কার্যকর হয়নি, তাই পৃথক থাকাই অনেকে বেছে নেন। এ-সংক্রান্ত আইনও বাংলাদেশে কার্যকর রয়েছে।
খোলা তালাকের পাশাপাশি আরেকটি তালাক রয়েছে, যাকে মোবারাত তালাক বলা হয়। এটি হলো পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদ। এ ধরনের বিবাহ বিচ্ছেদের বেলায় উভয়ই বিবাহ বিচ্ছেদে সম্মত হয় বলে কাউকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া লাগে না।
শারিয়া অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট ১৯৩৭ এই তালাকের বিধান ছিল। মুবারাত তালাকের প্রচলন খুব একটা নেই বললেই চলে। সংসার করার ক্ষেত্রে বিরূপ মনোভাবটি দু’জনের কাছ থেকে আসে তখন সেটা হয় মোবারত। মোবারতের ক্ষেত্রে চেয়ারম্যানের কাছে নোটিশ পাঠানোর দায়িত্ব যিনি প্রস্তাব উত্থাপন করবেন তিনি পাঠাবেন। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, মুবারাতের ক্ষেত্রে স্বামী এবং স্ত্রী দু’জনে মিলে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে তারা আর এক সাথে বসবাস করবেন না। মুবারাতের ক্ষেত্রেও একে অপরের কাছ থেকে দেনা পাওনার কোন বিষয় থাকে না। (১৬ ডিএলআর, ৩৮৯)।
লেখক: বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮