বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১১:০৮ অপরাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবে যা করণীয় জমি আপনার, দখল অন্যের! কী করবেন? রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান, আইনী নৈরাজ্য ও অতীত ইতিহাস! শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির মিথ্যাচার বনাম সাংবিধানিক সমাধান! সহায় সম্পত্তি পুণ্যের কাজে ওয়াক্ফ গঠন ও প্রাসঙ্গিকতা! শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামেঃ লালন কি জাত সংসারে— রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ায় আগমন বনাম দুধের মাছিদের আনাগোনা! জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত! ক্রেতা ঠকে গেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে যত আইনগত প্রতিকার! আইনে জামিন চর্চা বনাম বিচারকের পদত্যাগের দাবীতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ!
শারীরিক, আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ ভিকটিমদের জরিমানা আদায়ে আদালত এত নিষ্ঠুর কেন?

শারীরিক, আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ ভিকটিমদের জরিমানা আদায়ে আদালত এত নিষ্ঠুর কেন?

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: আমরা সবাই জানি, অপরাধের শিকার ব্যক্তি দু’ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হন। একটি শারীরিক অপরটি আর্থিক। শারীরিক ক্ষতির কারণে একজন ব্যক্তি সারা জীবনের জন্য অকর্মণ্য হয়ে যেতে পারেন; অন্যদিকে আর্থিক ক্ষতির কারণে তিনি নিঃস্ব হয়ে যেতে পারেন। অপরাধী ব্যক্তিকে আদালত বিচার প্রক্রিয়ার শেষে জেল ও সামান্য জরিমানা করে থাকেন। এতে অপরাধের শিকার ব্যক্তির কি যায় আসে। যদিও আমাদের দ-বিধি’র ৭০ ধারা আদালতকে জরিমানা আদায়ের ক্ষমতা দিয়েছেন এবং পৌজদারী কার্যবিধির ৩৮৬ ধারা আদালতকে সেই জরিমানা আদায়ের দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। যদিও এ ধারার শর্তাংশে জরিমানা অনাদায়ে আরও এতদিন কারাদন্ড দেয়া হলো এবং কারাদন্ড ভোগ করলে আদালত সেই জরিমানা আদায়ের পদক্ষেপ নিবেন না। কিন্তু জরিমানা অনাদায়ে অতিরিক্ত কারাদন্ড এটা আইনে বাধ্যতামূলক কিছু নয়, আদালতের ক্ষমতা মাত্র। দন্ডবিধির ৬৪ ধারায় এ বিষয়ে স্পষ্টই ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে। আবার ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪৫ এবং ৫৪৬এ ধারায় জরিমানার আদায়কৃত অর্থ থেকে ভিকটিমকে সুবিধা দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এ ধারাগুলোর ব্যবহার আমাদের আদালতগুলোতে একেবারে ব্যবহৃত হয় না বললেই চলে। আমাদের আদালতগুলো ভিকটিম বান্ধব নয়।

আবার অনেকে বলতে পারেন, শরীরের প্রতি ক্ষতিসাধন একটি ‘দেওয়ানী প্রকৃতির বিরোধ’। কারণ, দেওয়ানী কার্যবিধির ১৯ ধারায় শারীরিক ক্ষতিসাধনের জন্য যে দেওয়ানী মামলা করা যাবে তা বলা রয়েছে। আবার আমাদের ফৌজদারী কার্যবিধির ৫৪৫ এর (১বি) ধারায় বলা আছে, অপরাধের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরণের ক্ষতি সাধন হলে দেওয়ানী মামলার মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ আদায়যোগ্য হবে। তবে সেখানে বলা হয়েছে যে, সামান্য ক্ষতি বা জখমের কারণে প্রদেয় জরিমানার অর্থ থেকেই ভিকটিমকে তা প্রদান করার আদেশ দিতে পারবেন আদালত। কিন্তু শারীরিক ক্ষতির জন্য সিভিল মামলা, উক্ত মামলায় রায় ও ডিক্রি বাস্তবায়ন একটি অলীক বস্তুর মতো। তবে ফৌজদারী মামলার পাশাপাশি অপরাধের শিকার ব্যক্তি দেওয়ানী মামলাও করতে পারে। তবে ফৌজদারী মামলায় রায়ের পর দেওয়ানী মামলা করলে সেটাই সিদ্ধান্তকৃত হবে। তা না হলে দুটি আদালতের আলাদা আলাদা রায় হলে সেটা সাংঘর্ষিক হতে পারে। কারণ, ভিকটিমের দায়েরকৃত ফৌজদারী মামলার রায় ক্ষতিপূরণের জন্য দায়েরকৃত দেওয়ানী মামলার জন্য প্রাসঙ্গিক হবে বলে আমাদের সাক্ষ্য আইনের ৪৩ ধারায় ইঙ্গিত রয়েছে।
এখানে বলে রাখা বাহুল্য যে, আমাদের ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০ ধারার (২সি) উপধারাতে বলা হয়েছে যে, অপরাধের শিকার ব্যক্তি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক ঘোষিত মিথ্যা, তুচ্ছ ও বিরক্তিকর ফৌজদারী মামলার পরও ক্ষতিপূরণের জন্য দেওয়ানী মোকদ্দমা করতে পারবে।

আবার মিথ্যা মামলা করে অসহায় নিরীহ মানুষকে হয়রানির হাত থেকে রক্ষায় ফৌজদারী কার্যবিদির ২৫০ ধারার বিধান করা হয়েছে। কেউ যদি এমন মামলা করে যা মিথ্যা বা তুচ্ছ ও বিরক্তিজনক তবে সে মামলায় আসামীকে খালাস দিয়েই যেনো ম্যাজিস্ট্রেট নিরব না থেকে ফরিয়াদীকে তার এহেন কাজের জন্য প্রায়শ্চিত্তের আদেশ দিতে পারেন। আসামী যে টাকা পয়সা খরচ করল, যন্ত্রনা পোহাল এগুলোর জন্য ম্যাজিস্ট্রেট ক্ষতিপূরণ দেয়ার আদেশ দিতে পারেন ফরিয়াদির উপর। এ ক্ষমতা শুধু ম্যাজিস্ট্রেটের উপরই দেয়া রয়েছে; অন্য কোন সহকারী দায়রা জজের উপর নয়। তবে একটা বিষয় জেনে রাখা দরকার যে, মামলার যেকোন অবস্থায় ম্যাজিস্ট্রেট আসামীকে খালাস দিতে পারেন। কিন্তু বিশেষ ব্যতিক্রম ছাড়া সকল সাক্ষীকে পরীক্ষা ছাড়া ম্যাজিস্ট্রেট এরুপ ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন না বলে ৭ ডিএলআর ২৭০ পাতায় একটি সিদ্ধান্ত রিপোর্টেড রয়েছে।

আমাদের ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৮৬ ধারায় জরিমানা আদায়ে গ্রেফতারী পরোয়ানা ও এ সম্পর্কিত আইনী ব্যাখ্যা বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে প্রচার-প্রকাশ করে দায় এড়াতে চায়। এ পর্যায়ে একটি কেইস স্টাডি দিয়ে বিতর্কের অবসানের চেষ্টা করছি মাত্র। পাবনার জেলা প্রশাসক বেড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর দূর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ ব্যক্তিদের নিকট ত্রাণ হিসেবে বিতরণের জন্য ২০০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দিয়েছিলেন। উক্ত বরাদ্দকৃত চাল থেকে ২০ মেট্রিক টন চাল বেড়া পৌরসভার কমিশনার রওশন আলীর বরাবর এই মর্মে বরাদ্দ দেয়া হয় যে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকার লোকজনের নিকট তিনি যেনো মাস্টার রোলের ভিত্তিতে বিতরণ পূর্বক উপজেলা পরিষদের নিকট জমা দেন। কিন্তু তিনি ১,৯৬,৮০০ (এক লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার আটশত) টাকা মূল্যের ২০ মেট্রিক টন চাল ক্ষতিগ্রস্থ লোকদের মধ্যে বিতরণ না করে আত্মসাৎ করেন। ফলে উক্ত কমিশনার রওশন আলীর বিরুদ্ধে দন্ডবিধির ৪০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দূর্নীতি দমন ২ নং আইনের ৫(২) ধারায় অভিযোগ দায়ের হয়। বিভাগীয় বিশেষ বিচারকের আদালত ১২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য এবং দালিলিক কাগজপত্র বিবেচনা করে উক্ত দুটি ধারায় দোষী সাব্যস্থ করে আসামীকে ৩ বছরের কারাদন্ড ও ১,৯৬,৮০০ (এক লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার আটশত) টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও ৬ মাসের সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত করেন। উক্ত আদেশে সংক্ষুব্ধ হয়ে আপিলকারী মহামান্য হাইকোর্টে আপিল দায়ের করেন। শুনানী অন্তে হাইকোর্ট বিভাগ আপিলটি ডিসমিস করে দিয়ে জরিমানার ১,৯৬,৮০০ (এক লক্ষ ছিয়ানব্বই হাজার আটশত) টাকা আপিলকারীর নিকট থেকে আদায় করার নির্দেশ প্রদান করেন। উপরোক্ত কেইস স্টাডিটি মোঃ রওশন আলী বনাম রাষ্ট্র, ২০০২ বিএলডি, পৃষ্ঠা ৩৩ এ রিপোটেড রয়েছে।

উপরোক্ত সিদ্ধান্ত থেকে সকলের বোঝা দরকার যে, ফৌজদারী আদালত কর্তৃক আসামীর উপর আরোপিত জরিমানা শারীরিক দন্ডের পরিবর্তে আর্থিক দন্ড বিশেষ। সেক্ষেত্রে আসামী জরিমানা প্রদান করার পরিবর্তে তার উপর আরোপিত কারাদন্ড ভোগ বেছে নিতে পারে না। কারণ হিসেবে স্পষ্টই বলা যায় যে, ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৮৬ ধারার বিধান অনুসারে জরিমানা দেওয়ানী আদালতের ডিক্রির মতো একটি অবশ্য পরিশোধযোগ্য আদেশ বিশেষ। আসামীকে যদি জরিমানা পরিশোধের ব্যর্থতায় স্বেচ্ছায় কারাদন্ড ভোগ করার সুযোগ দেয়া হয় তাহলে জরিমানার উদ্দেশ্যে রীতিরকম ব্যহত হয়। কাজেই দূর্নীতির মামলায় আসামীকে তছরুপকৃত মালামালের মূল্যের সমপরিমাণ অর্থ একারণে জরিমানা করা হয় যেনো তদ্বারা রাষ্ট্রীয় ক্ষতির ক্ষতিপূরণ হতে পারে। যদি তা না করা হয়, তাহলে অপরাধীকে তদ্রুপ অপরাধ করতে উৎসাহিত করা হবে। শুধুমাত্র যেক্ষেত্রে দন্ডিত ব্যক্তির সম্পদের দ্বারা জরিমানার অর্থ পরিশোধ করা সম্ভব নয়, সেক্ষেত্রে দন্ডিত ব্যক্তির জরিমানার পরিবর্তে কারাদন্ড ভোগ করতে হয় এবং অন্য ক্ষেত্রে নয়।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইলঃseraj.pramanik@gmail.com,  মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮

 

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel