এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
হিল্লা বিয়ে একটি কুসংস্কার ও আমাদের দেশের প্রচলিত আইন বিরোধী। তালাকের পর নিয়ম মেনে একই ব্যক্তির সাথে বিয়ে করতে আইনে কোথাও বাঁধা নেই। মুসলিম আইনে এ ব্যপারে যথাযথ বিধান থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ‘নানা মুনির নানা মত’ নিয়ে শরিয়া নিয়মের অজুহাত দেখিয়ে কারও কারও দাম্পত্য জীবন বিষিয়ে তোলা হয়।
মূূলত হিল্লা বিয়ে হচ্ছে, তালাক হওয়া একই নারী বা পুরুষের মধ্যে পূণরায় বিয়ে হওয়ার ক্ষেত্রে তৃতীয় কোন ব্যক্তির কাছে একটি নিয়মের মাধ্যমে বিয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়া। ২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের একটি বেঞ্চ এ জাতীয় হিল্লা বিয়ে, ফতোয়াকে অবৈধ ও বেআইনি ঘোষণা করেছেন। হিল্লা বিয়ে সম্পর্কে এই রায়ে বলা হয়েছে, হিল্লা বিয়ের ফতোয়া হচ্ছে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা নম্বর ৭ এবং বাংলাদেশ দন্ডবিধির ধারা নম্বর ৪৯৪, ৪৯৮, ৫০৮ ও ৫০৯ লংঘন করা।
কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ নম্বর ধারাটি আমাদের সমাজে কতটুকু মানা হচ্ছে এবং এ সম্পর্কে সাধারণ জনগণ বা কথিত ইসলামী চিন্তাবিদরা কতটুকুই বা জানে। ‘১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ধারা ৭-এ বলা আছে, কোনো লোক যদি তাঁর স্ত্রীকে তালাক দিতে চান, তাহলে স্থানীয় চেয়ারম্যানের কাছে যত শিগগির সম্ভব লিখিত নোটিশ প্রদান করতে হবে এবং এর একটি কপি স্ত্রীকে দিতে হবে। নইলে তালাক কার্যকর হবে না। সুতরাং এখানে মৌখিক তালাকের অকার্যকরতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।
এ ধারায় বলা হয়েছে, নোটিশ জারি হওয়ার পর ৯০ দিন অতিবাহিত না হলে তালাক কার্যকর হবে না। পূর্ণভাবে তালাক কার্যকর হওয়ার পর স্ত্রী যদি স্বামীর কাছে ফিরে যেতে চান, তবে কাবিনের মাধ্যমে যথাযথ আইনগত পদ্ধতিতে পূণরায় বিয়ে করলেই যথেষ্ট হবে। এক্ষেত্রে তৃতীয় ব্যক্তির সঙ্গে সাময়িক বিয়ের প্রয়োজন নেই এবং তা তিন বার পর্যন্ত প্রযোজ্য হবে। তবে ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশে হিল্লা বিয়ের কিছু সংশোধিত বিধি লিপিবদ্ধ আছে। দম্পতির মধ্যে পূর্ণাঙ্গ তালাক হয়ে যাওয়ার পর যদি উভয় পক্ষ মনে করেন তাঁরা পূর্বাবস্থায় ফিরতে ইচ্ছুক, তবে বিয়ের কাবিন মোতাবেক তৃতীয় বার পর্যন্ত পূণর্বিবাহ করা যায়। কিন্তু তৃতীয়বারের পরে হিল্লা বিয়ের প্রয়োজন হবে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের কিছু বিধান নিয়ে মতভেদও রয়েছে। কিন্তু এই আইনের একটি ধারায় বলা আছে, এ আইন দেশে বলবৎ অন্য যে কোনো আইন বা প্রথা থেকে প্রাধান্য পাবে।
এখন আমরা জেনে নিই, ফতোয়া কি? ফতোয়া আরবী শব্দ যার অর্থ হচ্ছে ‘আইন সম্বন্ধীয় মত।’ ধর্মীয় আইনবিশেষজ্ঞ বা ফিকাহশাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান সম্পন্ন ব্যক্তিবর্গ ফতোয়া দিতে পারেন। যেকোনো পরিস্থিতিতে যখন শরিয়ত-সম্পর্কিত অনুশাসনগুলোতে কোনো জটিল প্রশ্নের সরাসরি মীমাংসা পাওয়া যায় না, তখন মুফতিরা সাধারণত ফতোয়ার মাধ্যমে পূর্ববর্তী নজির এনে সমাধান দেন। বর্তমানে যেসব ফতোয়া জারি করা হচ্ছে, তার মধ্যে দোররা মারা, পাথর ছুড়ে মারা, জুতাপেটা, মাথার চুল কেটে দেওয়া, বেঁধে পেটানো, মাটিতে অর্ধেক পুঁতে পাথর ছোড়া, হিল্লা বিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এসব নির্দেশ কোনো মতেই ফতোয়ার সুষ্পষ্ট সংজ্ঞাকে সমর্থন করে না। সব ঘটনা বাংলাদেশের সংবিধানের মৌলিক অধিকার-সম্পর্কিত যেসব বিধান আছে এর ২৭, ২৮, ৩১,ও ৩৫ অনুচ্ছেদের সরাসরি লংঘন। ২০০১ সালে হাইকোর্ট ডিভিশনের বেঞ্চ থেকে ফতোয়াকে যে অবৈধ বলে ঘোষণা করা হয়, তা সাইফুল ও শাহিদা দম্পতির মৌখিক তালাক ও হিল্লা বিয়েকে কেন্দ্র করে মামলার পরিপ্রেক্ষিতে দেওয়া হয়।
এ রায়ে স্পষ্টভবে বলা হয়, এসব ফতোয়া বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইনসহ বিভিন্ন আইনের লংঘন করা হচ্ছে। রায়ে বলা হয় কেবল তিনবার ‘তালাক’ (একবারে, বা এক এক করে তিনবারে) করলেই বিবাহ বিচ্ছেদ হয় না৷ এই চর্চা কোরান, হাদীস এমনকি মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ (ধারা-৭) এরও বিরোধী৷ ‘স্বামী কর্তৃক বিবাহ বিচ্ছেদের এই অসাধু পন্থা এবং এর অপপ্রয়োগ নবী স্বয়ং নিজেও দৃঢ়ভাবে নিষেধ করেছেন৷’ বাংলাদেশে হিল্লা বিয়ে সম্পূর্ণ বেআইনি কাজ ও আইনত দন্ডনীয়। হিল্লা বিয়ের উপস্থিত অতিথিসহ কাজীর ৬ মাসের জেলের বিধান করে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল আইয়ূব খান হিল্লা বিয়ে নিষিদ্ধকরণ সংক্রান্ত আইন করেন। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন ৭(৬) ধারা অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটলে, তালাক হওয়া দম্পতি আবার বিয়ে করতে চাইলে হিল্লা বিয়ে ছাড়াই পূণরায় বিয়ে করতে পারবে।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com