শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৭ অপরাহ্ন
মোঃ হাবিবুর রহমান:
একটি শিশুর প্রথম ভাললাগা শুরু হয় তার বিদ্যালয় থেকে। পরিবারের বাহিরে শিশুটি শিখবে তার পরিবেশ থেকে, শিখবে তার শিক্ষকদের থেকে, শিখবে তার সহপাঠীদের থেকে। বিদ্যালয় স্বপ্ন তৈরির স্থান যা স্বপ্ন দেখতে শেখায় শিক্ষার্থীদের। কীভাবে তারা জাতীয় জীবনে অবদান রাখবে, কীভাবে মানবতার সেবা করবে। বিদ্যালয়টির পরিবেশ হতে হবে স্থায়ীভাবে পরিপাটি , পরিচালন হবে সুশৃঙ্খল, হতে হবে শিশুদের জন্য আকর্ষণীয় শিক্ষণপদ্ধতি ও শিক্ষা উপকরণের সমাবেশ, শিক্ষার মান হতে হবে পরিপূর্ণ, পাঠক্রমের অতিরিক্ত প্রতিভা বিকাশের অনুকূল সাংস্কৃতিক-সামাজিক কার্যক্রম থাকতে হবে। তাহলেই আমরা বলতে পারবো এটি একটি আদর্শ বিদ্যালয়।
কেমন হতে পারে একটি আদর্শ বিদ্যালয়?
নির্দিষ্ট সংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্য অর্থ্যাৎ শিক্ষার্থী অনুপাতে ক্লাসরুম থাকতে হবে, পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য আলাদা শিক্ষক কক্ষ থাকতে হবে। বিদ্যালয়ের ভবনটি হতে হবে আকর্ষণীয় দৃষ্টিনন্দন সেখানে বিভিন্ন ধরণের শিক্ষণীয় ছবি থাকবে। ভবনের প্রত্যেকটি কক্ষ হবে শ্রেণিভিত্তিক সুসজ্জিত। বিদ্যালয়ে প্রবেশ করলেই একজন শিক্ষার্থীর ভাললাগা শুরু হবে।
শিক্ষার্থী অনুপাতে অবশ্যই শিক্ষক থাকতে হবে, শিক্ষকদের হতে হবে স্বপ্নদর্শী, সৃজনশীল, আতœবিশ্বাসী, তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন । সুন্দর বাচনভঙ্গি সহ আকর্ষণীয় উপস্থাপনার কৌশল, কাজের প্রতি ভালবাসা, অপরের মতামতের প্রতি গুরুত্ব দেয়া, ভালো শ্রোতা হওয়া, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, সহনশীলতা, পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব, জ্ঞানপিপাসু এসব গুনগুলো একজন শিক্ষকের অবশ্যই থাকতে হবে। একজন আদর্শ শিক্ষক ব্যতিরেকে আদর্শ বিদ্যালয় কল্পনাও করা যায়না।
শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য পাঠ্যবইয়ের বাইরেও জ্ঞানচর্চার নানা রকম ব্যবস্থা রাখতে হবে। যেমন- মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, পাঠাগার, উপকরণ কক্ষ, দেযালপত্রিকা, ফুল ও ফলের বাগান,ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকা- , কাবিং , হলদে পাখি, স্টুডেন্ট কাউন্সিল, ক্ষুদে ডাক্তার ।
মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম- শিক্ষার গুনগতমান নিশ্চিতকরণে শিক্ষাক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটাতে এবং শ্রেণী কার্যক্রমে অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের মতো প্রযুক্তিকেও একটি শিক্ষা উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে, শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন মেটাতে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম তৈরি করতে হবে। এর মাধ্যমে শিশু ছোট থেকেই বিজ্ঞান মনস্ক ও তথ্য প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হয়ে উঠবে।
পাঠাগার- পাঠাগারে শিশুতোষ, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বই সহ বিভিন্ন ধরনের বই থাকতে হবে। এছাড়াও শিশু সাময়িকী ও জাতীয় পত্রিকাও রাখা যেতে পারে।
উপকরণ কক্ষ-এই কক্ষে বাঘ, ভল্লুক, হরিণ, পাখি, গাড়ি-ঘোড়াসহ বিভিন্ন প্রাণীর মডেল ও নানা ধরনের খেলনা, গ্লোব , মানচিত্রসহ দেশ-বিদেশের বরেণ্য কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী-রাষ্ট্রনেতা প্রমুখের ছবি রাখতে হবে। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, শরৎচন্দ্র বা সুকুমার সেনকে শিশুরা চিনে নিতে পারবে এখান থেকেই। ছবি দেখে শেখা মানে তাদের মনের মন্দিরে গেঁথে থাকা।
দেয়ালপত্রিকা- শিশুদের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে তিন মাস পরপর বিভিন্ন নামের দেয়ালপত্রিকা প্রকাশ করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের লেখা গল্প-কবিতা-কার্টুন-ছবি স্থান পাবে। মাঝে মাঝে বিশেষ সংকলনও প্রকাশ করতে হবে।
ফুল ও ফলের বাগান– কোমলমতি শিশুরা যাতে প্রকৃতির সাহচর্যে বেড়ে উঠতে পারে, সেজন্য ফলজ, কাঠ ও ঔষধি গাছ লাগাতে হবে। বিদ্যালয়টির সৌন্দর্য বর্ধনের জন্যও একটি ফুলের বাগান তৈরি করা আবশ্যক।
ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকা – শিশুদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতার জন্য পড়াশুনার পাশাপাশি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের বিকল্প নেই। ক্রীড়া যেমন ফুটবল ,ক্রিকেট, ব্যাডমিন্টন, দৌড়, বল নিক্ষেপ, উচ্চ লাফ, দীর্ঘ লাফ ইত্যাদির আয়োজন করতে হবে। সাংস্কৃতিক যেমন বিভিন্ন ধরনের নাচ, গান , কবিতা, চিত্রাংকন ইত্যাদির আংয়োজন করতে হবে।
অন্যান্য কর্মকাণ্ড নির্ধারিত দিনে রুটিন মাফিক কাবিং, হলদে পাখি, স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠন, ক্ষুদে ডাক্তার দ্বারা শিক্ষার্থীদের চোখ, ওজন ইত্যাদি পরিমাপ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
বইয়ের বাইরে- শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবিষয়ের বাইরেও পারিবারিক ও সামাজিক নানা বিষয়ে সচেতন করে তুলতে হবে। যেমন – পানি বিশুদ্ধকরণ, খাবার স্যালাইন তৈরি, বাড়িতে স্যানিটেশন ব্যবস্থা, পাঁচটি ব্যাধি থেকে রক্ষায় শিশুদের টিকা গ্রহণ, র্যালির মাধ্যমে এলাকাবাসীকে সচেতন ও উদ্ধুদ্ধকরণ এমনকি গ্রামে গ্রামে স্যানিটেশন ও খাবার স্যালাইনের উপকারিতা নিয়ে নাটকও করা যেতে পারে।
শিশু ও অভিভাবকদের জন্য শিক্ষণীয় বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। যার দ্বারা একজন শিশু মেধাবীসহ আদর্শবান নাগরিক হয়ে দেশ এবং সমাজের উন্নতি সাধনে নিজেকে আত্মনিয়োগ করতে পারে।
অভিভাবকদের জন্য ”আনন্দ পাঠাগার” স্থাপন-বিদ্যালয়ের গেটে ঢুকতেই তৈরি করতে হবে আনন্দ পাঠাগার। শিশুদের জন্য অপেক্ষাকালে মায়েরা শিশু বিষয়ক গল্পের বইসহ বিভিন্ন বই পড়বেন এবং বাড়িতে গিয়ে সেগুলো সন্তানদের শোনাবেন।
বিদ্যালয়ে থাকবে ”মহানুভবতার দেয়াল” যেখানে থাকবে কিছু পুরোনো কাপড় চোপড়, যাদের প্রয়োজন নেই তারা রেখে যাবে আর যাদের দরকার তারা সেগুলো নিয়ে যেতে পারবে। অপচয় না করে সীমিত সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার শিশুরা ছোটবেলাতেই শিখবে।
আরও হতে পারে ”আলোকিত আচরণ সংগ্রহশালা” এর মাধ্যমে বিদ্যালয়ের কোন ছাত্র ছাত্রী অনুকরণীয় ভালো কাজ করলে, তার ছবি এই দেয়ালে বা সংগ্রহশালায় প্রকাশ করা হবে যাতে অন্যরা ভালো কাজে উৎসাহিত হয়।
বিদ্যালয়ে থাকবে একটি Honesty Shop যেখানে সাজানো থাকবে শুকনো খাবার আর স্টেশনারি দ্রব্য কিন্তু কোন বিক্রেতা থাকবে না। ছাত্রছাত্রীরা যার যেটা প্রয়োজন নিয়ে যাবে আর স্বচ্ছ ক্যাশ বাক্সে জিনিষের দাম রেখে যাবে।
এছাড়াও শ্রেণিভিত্তিক শিশুদের মাঝে প্রতিযোগীতার মনোভাব তৈরির জন্য Student of The Month/ Student of The Year এবং প্রতি মাসে অথবা অধ্যায় শেষে কুইজ কুইজ প্রতিযোগিতার আয়োজন করা যেতে পারে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ সকল শিক্ষক, বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির (এসএমসি) সদস্যবৃন্দ , স্থানীয় জনপ্রতিনিধি , স্থানীয় গণ্যমাণ্য ব্যক্তি সহ বিদ্যালয়ের সাথে জড়িত সকলের আন্তরিক প্রচেষ্টাই গড়ে উঠতে পারে একটি স্বপ্নের বিদ্যালয় যাকে আমরা বলতে পারি একটি আদর্শ বিদ্যালয় ।
লেখকঃ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, কুষ্টিয়া সদর, কুষ্টিয়া।