মোঃ হাবিবুর রহমান:
জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ এ প্রাক প্রাথমিক শিক্ষাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হযেছে। শিশুদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা শুরুর আগে তার অন্তর্নিহিত অপার বিস্ময়বোধ, অসীম কৌতুহল, আনন্দবোধ ও অফুরন্ত উদ্যমের মতো সর্বজনীন মানবিক বৃত্তির বিকাশ এবং প্রয়োজনীয় মানসিক ও দৈহিক প্রস্তুতিগ্রহণের পরিবেশ তৈরি করার জন্য বিদ্যালয় প্রস্তুতিমূলক প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা জরুরি।এই প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা শিশুর মধ্যে শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টিতে সহায়ক হবে। বিগত ২০০০ সাল হতে ৫+ বছর বয়স্ক শিশুর প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা চলমান আছে। ভবিষ্যতে ৪+ বছর বয়স্ক শিশুর প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা চালু হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার উদ্দেশ্যই হলো শিশুর শিক্ষার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করা। একটি নির্ধারিত রুটিন যেমন দৈনিক সমাবেশ, ব্যায়াম, নাচ-গান, নির্দেশনার খেলা, গণিত, ইচ্ছেমত খেলা এই সমস্ত কাজগুলো করে শিশুরা আনন্দ সহকারে শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। মূল উদ্দেশ্য হলো স্কুল ভীতি দূর করে সকল শিশুর সাথে সহনশীল আচরণ, আনুষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য শৃঙ্খলাবোধ এবং বিদ্যালয়ের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি। আমরা কি সত্যিই পেরেছি শিশুদের এই আগ্রহ সৃষ্টি করতে? আমরা কি পেরেছি সকল ৫+ বছর বয়স্ক শিশুর জন্য সমান শিক্ষা দিতে? শিক্ষা নীতি অনুসারে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থা সবার জন্য সমান অর্থ্যাৎ সব শ্রেণী, পেশার জনগোষ্ঠীর জন্য একই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এখানে কেউ কেউ অর্থ খরচ করে প্রাইভেট স্কুলে পড়াচ্ছে যেখানে শিক্ষাদান পদ্ধতি ভিন্নতর। অন্যদিকে সাধারন জনগোষ্ঠী সরকারী স্কুলে পড়াচ্ছেন যেখানে শিক্ষাদান পদ্ধতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর অর্থ্যাৎ সরকার কর্তৃক নির্ধারিত। আর্থ সামাজিক প্রেক্ষাপটও বিবেচনা করলে শিক্ষা ব্যবস্থা ভিন্নতর লক্ষ্য করা যায়। যেমন- অবস্থানগত দিক বিবেচনা করলে দেখা যায় শহরকেন্দ্রিক শিক্ষা এবং গ্রামকেন্দ্রিক শিক্ষা। এছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে চর, হাওড় ও বাওড় এলাকার শিশুদের শিক্ষাও উল্লেখ করতে হয়। তাদেরকে প্রতিনিয়ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্য দিয়ে শিক্ষা গ্রহণ করতে হয় যা কষ্টসাধ্য। শহরে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দেখা যায় যার মধ্যে সরকারী, বেসরকারী, যেখানে সেখানে গজিয়ে উঠা অনুমোদনহীন কিছু কেজি স্কুল। শহরের শিক্ষিত সচেতন অভিভাবকগণ তাদের সন্তানদের এই সকল বিদ্যালয়ে ভর্তি করে থাকেন। এখানে অভিভাবকগণ তাদের শিশুর প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে খুবই সচেতন। অপরদিকে গ্রামাঞ্চলের অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের প্রতি মোটেও সচেতন নয় বিধায় শিশু শিক্ষার প্রতি খুব বেশি আগ্রহও তাদের নেই।
অন্যদিকে সরকারী স্কুল বনাম কেজি কিংবা প্রাইভেট স্কুল। সরকারী স্কুলে ভর্তিকৃত শিশুর অভিভাবকগণ মনে করেন , শিক্ষকগণই সবকিছু শিখিয়ে দিবেন। তাদের নজর দেয়ার কিছু নাই। কেজি স্কুলে ভর্তিকৃত শিশুর অভিভাবকগণ শিশু শিক্ষার প্রতি সচেতন। এছাড়াও কেজি স্কুলে ৩+ বছর বয়স্ক শিশু ভর্তি করানো হয় যা সরকারী নির্দেশনা বহির্ভূত। প্রাইভেট স্কুলগুলো শিশু থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তক গ্রহণ ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক নির্দেশিত কোন নিয়মকানুন মেনে চলে না। এসব স্কুলগুলো পর্যবেক্ষণ করারও কোন সুযোগ নেই। ২০১১ সালে বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নিবন্ধন বিধিমালা প্রণীত হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই বললেই চলে।
আমাদের প্রচলিত প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার মান এবং সেবার ক্ষেত্রটি ক্ষেত্র ভেদে পার্থক্য আছে। অনেক স্কুলের অবকাঠামোগত মান উন্নত নয়, সুযোগ সুবিধার অপর্যাপ্ত । পর্যাপ্ত শিক্ষক, শিক্ষা ও খেলার সামগ্রি, বই, শ্রেণী কক্ষ ,পরিস্কার পরিচ্ছন্নতা ও নিরাপদ পানির সং¯থান এবং টয়লেট সুযোগ সুবিধা অপর্যাপ্ত। এ সমস্ত অত্য্বাশ্যকীয় চাহিদা ও সেবা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধ পরিকর এবং ইতিমধ্যেই অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং স্যানিটেশন ব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নয়ন হয়েছে। একটি শিশুবান্ধব শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করতে সরকার প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সার্বজনীন এবং বৈষম্যহীন শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করতে ব্যাপক উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সে বিবেচনায় বস্তি এবং পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দিয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন ভাষাভাষি নৃগোষ্ঠির শিশুরা, অবহেলিত বা বঞ্চিত শিশুদের সামগ্রিকভাবে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা কর্মসূচির আওতায় এনে সব শিশুর আনন্দায়ক শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
গুনগত মানসম্পন্ন প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ।
একজন শিশুর নিজের প্রাক প্রথিমিক শিক্ষার আগ্রহ তৈরির পূর্বে অসচেতন নিরক্ষর জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার সুফল সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। তাদেরকে বয়স্ক ও উপানুষ্ঠানিক শিক্ষার আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে।
সরকারী স্কুলগুলোকে শিশুবান্ধব প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হবে যেন শিশুরা কেজি কিংবা প্রাইভেট স্বুলমুখী না হয়।
গুনগত মান সম্পন্ন সেবা প্রদানের সুবিধার্থে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে হবে, দক্ষতার সাথে সার্বিক তত্বাবধান, পরিবীক্ষণ এবং মূল্যায়ন করতে হবে।
জাতীয় পাঠ্যক্রম অনুসরণ করতে হবে।
মাঠ পর্যায় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষা প্রসারে প্রশাসনিক ও ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রনয়ণের অংশ হিসেবে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি শিশু এবং অভিভাবকদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টির অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক, শিক্ষার উপকরণ সামগ্রী এবং সকল ধরনের সুযোগ সুবিধা বাড়াতে হবে।
প্রাক প্রাথমিক শিক্ষাকে গুনগত মানসম্পন্ন করার জন্য
শ্রেনিকক্ষগুলো বাস্তব উপকরণ, পাঠ সংশ্লিষ্ট ছবি দিয়ে সজ্জিতকরণ করতে হবে।
শ্রেণিকার্যক্রমে শিশুদের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে।
শিশুদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে।
শ্রেণিকক্ষগুলো প্রযুক্তিনির্ভর করতে হবে।
শিক্ষার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ও শারীরিক উন্নতির জন্য পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।
পরীক্ষা ভীতি দূর করার জন্য প্রাক প্রাথমিক শিক্ষায় কোনো আনুষ্ঠানিক পরীক্ষা নেয়া যাবে না।
শিক্ষকদের বিভিন্ন মেয়াদে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং পুনরায় জবাবদিহির ব্যবস্থা করতে হবে।
শিশুরা জন্মগতভাবে প্রকৃতি এবং পারিবারিক অবস্থা থেকে অনেক কিছুই শিখে থাকে। প্রাকৃতিক ও ব্যবহারিক জীবন থেকে শিশুরা যা শিখে থাকে সেটাই তাদের বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে কাজে লাগে এবং অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধশালী হয়। শিশু বেড়ে উঠার সাথে সাথে শিশুদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা তাদের অনুসন্ধিৎসু মন চার পাশের জীবন ও চলমান বিষয়কে জানার আগ্রহ সৃষ্টি করে। তাই বাসস্থান, বিদ্যালয় এবং পরিবেশ নিয়ে যে জগতে শিশুর অবস্থান সেখানে যত বেশি শিশুবান্ধব সুযোগ সুবিধা সৃষ্টি করা যাবে ততই তারা বিকশিত হবে। শিশুর সার্বিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে। শিশু শিক্ষার গুনগত মান বজায় রাখতে সংশ্লিষ্ট সকলকে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে হবে। আমাদের যে সব শিশুরা প্রাক প্রথিমিক শিক্ষার উপকারিতা এবং ভবিষ্যৎ সুফল সম্পর্কে অবহিত নয় তাদের কাছে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার বার্তা পৌছে দিতে হবে প্রয়োজনে গণমাধ্যমে প্রাক প্রাথমিক শিক্ষার সুফল তুলে ধরে ব্যাপক প্রচারনা চালানো যেতে পারে। শিশু শিক্ষার আলো প্রতিটি ঘরে ঘরে ছড়িয়ে দিতে সরকারের পাশাপাশি আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
লেখকঃ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, কুষ্টিয়া সদর, কুষ্টিয়া।
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com