বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:০৯ পূর্বাহ্ন
মোঃ হাবিবুর রহমান:
ভাবের আদান প্রদানের প্রয়োজনীয়তায় কথা। আর কথা লিখে প্রকাশ করতে এবং সংরক্ষণ করতে মানুষ আবিষ্কার করেছে লিপি। পৃথিবীতে অনেক ভাষা, অনেক তার লিপি। আমরা বাংলাদেশের মানুষ , আমাদের ভাষা বাংলা। প্রাচীন ব্রাী লিপি থেকে আমাদের ভাষা লিপির উৎপত্তি। বাংলা ভাষার বর্ণ / অক্ষর ৫০টি। এছাড়াও কিছু কার চিহ্ন রয়েছে। এবার বণর্ থেকে কথার বানান; তা থেকে বাক্য।
এ শিক্ষা প্রথম রপ্ত করেন ধর্ম অনুরাগী পন্ডিত ব্যক্তি যারা- আধ্যাত্মিক, যারা দার্শনিক। এরাই ধর্মীয় দীক্ষার পাশাপাশি উপসানালয় শিষ্যদের বর্ণ পরিচয় পুস্তিকা পড়াতেন। শিক্ষার্থীরা এতটুকু বিদ্যা চর্চা করে জীবনে কাজে লাগাতেন। এ অবস্থা চলতে থাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী। রাজা কোনো পন্ডিত ব্যক্তির মাধ্যমে নিজ বংশের লোকদের শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করতেন। সে শিক্ষা অন্যদের গ্রহণ করার কোনো সুযোগ থাকতো না। এদেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় শিক্ষার প্রতি নজর আসে ইংরেজি শাসন আমলে। ১৯৫৪ সালে উড এর ডেসপ্যাচ তত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলায় আধুনিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন উইলিয়াম অ্যাডাম। দিন যায়, প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চতর শিক্ষার চালুর মৃদু বাতাস বইতে থাকে। ১৯১০ সালে লর্ড কার্জন এর প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামুলক করার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলেও তা পৌর এলাকায় বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গৃহীত হয়। ১৯৩০ সাল থেকে গ্রাম অঞ্চলে এ ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে উৎসাহিত করা হয়। সেগুলো স্থানীয় উদ্যোগে পরিচালিত হতো। দেশ বিভাগের পরবর্তী সময়ে ১৯৪৭ সালে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক ও বিনা মূল্যে প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা চার বছরের পরিবর্তে ৫ বছর মেয়াদী করার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৫২ সালে। ১৯৫৭ সালে এ শিক্ষা সার্বিক তদারকির জন্য জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারদের উপর দায়িত্ব ন্যাস্ত করা হয়। ১৯৫৯ সালে পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনায় প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। এতে ৮ বছর মেয়াদী প্রাথমিক শিক্ষার সুপারিশ করা হয়। সে সময়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ছিল একবারেই সীমিত। শিক্ষকদের অনেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা ছিল এস,এস,সি’র নীচে। তাঁদের জন্য গুরু ট্রেনিং এর ব্যবস্থা ছিল। ঐ যোগ্যতা নিয়েই তাঁরা পেশার দায়িত্ব পালন করতেন এবং নাম মাত্র ভাতা পেতেন। এ ভাতাও আবার যোগ্যতা অনুসারে কম-বেশি করে দেয়া হতো।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করলে কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন নারী শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রাথমিক শিক্ষা ৮ বছর মেয়াদী করার সুপারিশ করে। এ কমিশনও প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক রাখার পক্ষে যুক্তি পেশ করে।
প্রাথমিক শিক্ষা আমাদের দেশে মূলত : দুই ধারায় বিভক্ত। একটি ধারা সাধারণ শিক্ষা; যারা সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অবৈতনিক এবং ব্যক্তি উদ্যোগে পরিচালিত বৈতনিক। এরা উভয়ই সরকারি ক্যারিকুলাম অনুযায়ী সকল শিক্ষার সমন্বয়ে পাঠদান করে থাকে। অন্য ধারাটি হলো ধর্মীয় শিক্ষা। এখানে ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ মূখ্য, অন্য বিষয়গুলির উপর তেমন জোর দেয়া হয় না।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতার মাত্র ২ বছরের মাথায় দেশে প্রতিষ্ঠিত ৩৬,১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন। শিক্ষকগণ হলেন খোদ সরকারি কর্মচারী। বিদ্যালয় গৃহ ছিল টিন/ খড়ের তৈরি। আসবাবপত্র যা ছিল তা একেবারেই অপ্রতুল। বিদ্যালয় গমনোপযোগী শিশুরা ছিল খেয়ালীমনা। শিক্ষা গ্রহণ একটি শিশুর মৌলিক অধিকার সে বিষয়টা স্বয়ং অবিভাবকই বুঝতে শেখেনি। বড় একটা অজুহাত ছিল দারিদ্রতা। নব্বই দশকের শেষের দিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনা মূল্যে বই বিতরণ শুরু করা হয়। এর সুফলে প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরই মাঝে দেশে প্রায় ২০ হাজারের মত বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় গড়ে ওঠে।; যাঁরা জাতীয়করণের প্রত্যাশায় রত থাকেন। সরকারিভাবে মনিটরিং এর ব্যবস্থা না থাকায় বিদ্যালয়গুলোর অবস্থা তেমন ভালো ছিল না। ১৯৯১ সাল থেকে ঐ শিক্ষকদের মাসিক ৫০০ টাকা করে ভাতার ব্যবস্থা করা হয়। তখন থেকে মনিটরিং এর ব্যবস্থা জোরদার করা সহ অবকাঠামো উন্নয়নে সরকার জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সরকারি শিক্ষকদের মত তাদেরও বিভিন্ন ট্রেনিং এ অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়।
শিশু ভর্তির হার বৃদ্ধির লক্ষ্যে সমস্যাগ্রস্থ পরিবারের কথা ভেবে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন সরকার গ্রামীন ৪৫ ভাগ শিক্ষার্থীর জন্য মাসিক ২০ টাকা হারে উপবৃত্তি প্রদানের ব্যবস্থা করেন যা এখন ১৫০ টাকায় উন্নীত করা হয়েছে।
২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা পিতার দেখানো পথ অনুসরন করে ২৬,১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণের ঘোষনা দেন। এতে করে শিক্ষকদের বেতন বৈষ্যম্য দূর হওয়াসহ মানবেতর জীবনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেয়েছে। শিশু ভর্তি শতভাগ নিশ্চিত হয়েছে।
দেশের প্রাথমিক শিক্ষা কাঙ্খিত মানে পৌছানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। (১) বেসরকারি বিদ্যালয় জাতীয়করণ চলমান (২) বরাদ্দ বেশি করে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন (৩) প্রাক-প্রাথমিক চালু করা (৪) শতভাগ ভর্তি নিশ্চিত করা (৫) বছরের প্রথম দিনে বই বিতরণ (৬) ঝরে পড়া রোধ করা (৭) নতুন ক্যারিকুলাম চালু করা (৮) অভিন্ন প্রশ্নে পরীক্ষা গ্রহণ (৯) বিদ্যালয়ে ইন্টারনেট ব্যবহার (১০) ই-মনিটরিং এর মাধ্যমে পরিদর্শনের ব্যবস্থা (১১) পিটিআইতে ডিভাইস স্থাপন (১২) সিইনএড প্রশিক্ষণের মেয়াদকাল ১৮ মাস (১৩) সংগীত, ক্রীড়া, চারুকারু বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা (১৪) নীড বেজড সাবক্লাস্টার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা (১৫) জাতীয় শিশু পুরস্কার চালু করা (১৬) বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্ণামেন্ট ও বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্ণামেন্ট চালু করে শিশু মননশীল বৃদ্ধি করা (১৭) ২০১০ সাল থেকে স্টুডেন্টস কাউন্সিল গঠন প্রবর্তন করা (১৮) স্লিপ কার্যক্রমের মাধ্যমে বিদ্যালয়কে শিশু বান্ধব করে গড়ে তোলা (১৯) সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের জন্য আনন্দ স্কুল গড়ে তোলা (২০) প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রয়োজনীয় উপকরণ প্রদান চালু রাখা (২১) অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলমান রাখা (২২) জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০ এর আলোকে ৮ম শ্রেণি পর্যন্ত চালুর ব্যবস্থা রাখা (২৩) শ্রেষ্ঠ শিক্ষকদের বিদেশ ভ্রমনের ব্যবস্থা করা (২৪) শাস্তিমুক্ত পাঠদান ব্যবস্থা চালু রাখা (২৫) ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি পদে একজন সুশিক্ষিত জনকে নির্বাচিত করার বিধান রাখা।
এছাড়া আমার নিজস্ব অভিমত তুলে ধরার চেষ্টা করছি ঃ (১) শিক্ষকতা পেশার জন্য যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেয়া। (২) সকল শিক্ষকদের বেতন কাঠামো যুগোপযোগী করা (৩) প্রধান শিক্ষকের মর্যাদা বৃদ্ধি করা (৪) একঘেয়েমি দূর করতে একটা নির্দিষ্ট সময় পর পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির ব্যবস্থা করা। (৫) প্রধান শিক্ষকদের কর্মপরিধি বিদ্যালয়ে সীমাবদ্ধ রাখা (৬) প্রয়োজনে প্রতিটি বিদ্যালয়ে একজন হিসাব সহকারি এবং একজন আয়া নিয়োগের ব্যবস্থা করা। (৭) পিটিআই প্রশিক্ষণের মেয়াদ ১ বছর করা। (৮) ১ জন ধর্মীয় শিক্ষক নিয়োগের ব্যবস্থা করা (৯) ২ বছর পর পর শূণ্য পদে নিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থা চালু করা (১০) ২ বছর পর পর ৬টি বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রাখা (১১) কেজি শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাসহ সরকারের মনিটরিং এর আওতায় নিয়ে আসা। (১২) প্রাথমিক শিক্ষা সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেয়ার লক্ষ্যে বেদে পল্লীতে খন্ডকালীন শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা (১৩) সর্বোপরি মনিটরিং ব্যবস্থা জোরদার করা।
লেখকঃ সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসার, কুষ্টিয়া সদর, কুষ্টিয়া।