শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০৮ অপরাহ্ন
সিরাজ প্রামাণিক:
সাংবাদিকতার শুরু থেকে জেনে এসেছি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ সংবাদপত্র। আর এ স্তম্ভের কারিগর হলো সাংবাদিক সমাজ। অথচ অপসাংবাদিকতার ভিড়ে প্রকৃত সাংবাদিকতা আজ ভূলণ্ঠিত। কারা করছে এসব? কেন মর্যাদাসম্পন্ন সাংবাদিকতা পেশা আজ মর্যাদা হারাচ্ছে? কেন শুদ্ধতার মাঝে ঢুকে পরেছে নাম সর্বস্ব অপসাংবাদিকতা? দেখে শুনে মনে হয় সাংবাদিকতা যেনো পেশা নয়, এক অসুস্থ ব্যবসা। অশিক্ষিত, কুশিক্ষিতরা অর্থের বিনিময়ে আন্ডরগ্রাউন্ড পত্রিকার পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে মানুষকে ভয়ভীতি; আর সরলতার সুযোগ নিয়ে হরদম প্রতারণা করছে।
আনন্দের সংবাদ এই যে, আমাদের দেশে সাংবাদিক হতে কোন সুনির্দিষ্ট শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না। হুট করেই সাংবাদিক হয়ে যেতে পারে যে কেউ। ফলে এলাকায় টাউট হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিরা ঢাকাসহ জেলা শহর থেকে প্রকাশিত বিভিন্ন অখ্যাত-কুখ্যাত পত্রিকার পরিচয়পত্র সংগ্রহ করে সাংবাদিক হয়ে যায় এবং প্রশাসনে ও রাজনৈতিক মহলে উদ্দেশ্যমূলক খবরদারি করে। স্বঘোষিত সাংবাদিক হওয়া কিছু টাউট সংবাদকর্মী মোটরসাইকেলে অথবা প্রাইভেটকারে সাংবাদিক বা প্রেস লিখে অবাধে চলাফেরা করছে। সরকারি বেসরকারি দফতরের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী এসব টাউট সংবাদকর্মীদের সমীহ করছে, আবার তাদের অপকর্মে সহযোগিতা নিচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। শুধু এখানেই থেমে নেই টাউট হিসেবে চিহ্নিত এসব সংবাদকর্মীরা—–।
সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে কারা নীতিমালা করবেন? নীতিমালা কি হবে? আর এসব সামলাবেই বা কে? আমি সাংবাদিকদের এজন্য একটি নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এবং বিধিমালা তৈরির পক্ষে। সব পেশারই লাইসেন্স প্রদানকারী একটি প্রতিষ্ঠান থাকে। যেমন আইনজীবী, ডাক্তারকে যোগ্যতা প্রমাণ করে সনদ নিয়েই ব্যবসা করতে হয়। সনদ থাকার কারণে সাধারণ মানুষরা বুঝতে পারে যে তিনি সেবা দেয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন কী-না। সেবা প্রদানে গুরুতর কোন অনৈতিকতা থাকলে সনদ বাতিলের সম্ভাবনা থাকে, জবাবদিহিতা থাকে। সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও তা হওয়া দরকার।
মোদ্দা কথা হলো, দেশজুড়ে এভাবে সংবাদপত্রের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। কোথাও কোথাও মাদক সরবরাহের কাজ করা হয় সংবাদপত্র লেখা গাড়ি দিয়ে। এই হচ্ছে আমাদের সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার পরিণতি। আজকাল মাঠ পর্যায়ে গিয়ে এ পেশা সম্পর্কে নানা নেতিবাচক মন্তব্য অনেকের কাছে শুনতে হয়।
কথিত সাংবাদিক নেতাদের উদ্দেশ্যে বলছি, রাজনীতি ও সাংবাদিকতা এক সাথে করা যায় না। আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আপনি মিছিলে স্লোগান ধরবেন, নাকি মিছিলের ছবি তুলবেন? আপনি ভাষণ দিবেন নাকি কারো ভাষণ কোট করবেন? আপনি রাজনৈতিক দলের কর্মী হবেন নাকি সংবাদ কর্মী হবেন? আপনি যদি বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের কর্মী পরিচয় দেন, তাহলে অন্য দলের খবর সংগ্রহ করা আপনার জন্য কঠিন হবে। জনগণের মাঝে আপনার গ্রহণযোগ্যতা কমবে। নিরপেক্ষতা হারাবেন। বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ থেকে জনগণ বঞ্চিত হতে পারে। তাই সাংবাদিকতা করতে রাজনীতি থেকে চিরতরে বিদায় নিতে হবে। প্রেসক্লাবের গঠনতন্ত্রেও তাই বলা হয়েছে। কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য প্রেস ক্লাবের সদস্য হতে পারে না।
কিন্তু প্রত্যেক সাংবাদিকের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন মত ও পথের চিন্তা থাকতে পারে। কিন্তু দেশ ও জনগনের জন্য রাজনীতি করলে সাংবাদিকরা আপনার কথাই লিখবে। দেশ প্রেমিক রাজনৈতিক নেতা হতে পারলে সাংবাদিকরা আপনার ছবি তোলে মাথায় তুলে রাখবে। অন্য দিকে সৎ সাংবাদিক হতে পারলে জনগনই আপনাকে মাথায় তুলে রাখবে। তাই সিদ্ধান্ত নিন, রাজনীতি করবেন নাকি সাংবাদিকতা করবেন?
সাংবাদিকদের অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে পড়ার প্রবণতা দেখে নানা জন নানা মন্তব্য করেন। কেউ কেউ তো সাংবাদিকদের ‘ভ-‘ বলেও মন্তব্য করেছেন। আবার কিছু কিছু পাঠক জানান সাংবাদিকরা অপরাধের সাথে জড়িত নন, বরং কিছু অপরাধীই সাংবাদিক হয়েছেন৷ তা না হলে উপযুক্ত শিক্ষা ছাড়া পান দোকানদাররাও সম্পাদক হয়েছেন, হচ্ছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বোদ্ধা পাঠক জানান, ৯০ শতাংশ সাংবাদিক নিরপেক্ষ না, বরং ভ-৷ এরা হয় আওয়ামী লীগ, নয় বিএনপি৷ বাংলাদেশে সবাই যখন অপরাধ করছে, ওরাই বা কেন পিছনে থাকবে? এই সোজা সাপটা প্রশ্ন আরেক সমাজকর্মীর।
সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকতার মর্যাদা যেন ভূলণ্ঠিত না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে সাংবাদিক নেতাদের। সাংবাদিকদের বিভক্তি আর অপসাংবাদিকদের অপতৎপরতার সুযোগ নিচ্ছে রাজনৈতিক ও সামাজিক দুর্বৃত্তরা। নিরাপত্তার অভাবে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে মুক্ত সাংবাদিকতার দ্বার। ফিরে আসুক সাংবাদিকতার মর্যাদা; নিরাপদ আর মুক্ত হাতে কলম ধরার পরিবেশ ফিরে পাক সাংবাদিকরা; রাহুমুক্ত হোক সংবাদপত্র। এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।
সবশেষ সাংবাদিক ভাইদের সমীপে নিবেদন, ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ থাকুন। ঐক্যবদ্ধ থাকলে নেতৃত্ব আপনারাও দিতে পারবেন। না হয় সবাই লাঞ্চিত হতেই থাকবেন। অশুভ শক্তি আপনাদের ক্ষতিই করবে। এটা কারো কাম্য হতে পারে না।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com