বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৩ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
এবার সাংবাদিক ব্যাটা মিথ্যা কথা লেখায় গ্রেফতার হয়েছে। স্বাধীনতা দিবসে দ্রব্যমূল্য নিয়ে একজন শ্রমিক বলেছিলেন ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব।’ এই সংবাদ প্রকাশ করায় প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধিকে মধ্যরাতে সাদা পোশাকের একদল ব্যক্তি দিয়ে ধরে নিয়ে গেছে।
সাংবাদিক আর উকিল ব্যাটারা খালি মিথ্যো কথা বলে। শুধু ব্যবসায়ীরা ঘুষ খাই না, মিথ্যা বলে না। ২ টাকার জিনিস ২০ টাকায় বিক্রি করে আর বেশী লাভের আশায় খাদ্যে ভেজাল দেয়। রমজান এলেই দাম আরও বাড়িয়ে দেয়। শিক্ষকেরা তো জাতির মেরুদন্ড। ওনারা ঘুষ খায় না, প্রাইভেট পড়লেই পাশ করিয়ে দেন। ডাক্তার সে-তো মানবসেবী। ওনারার ঘুষ টুুষ খান না, শুধু মাকে নরমাল ডেলিভারী না করে ভয় দেখিয়ে বেশী টাকার জন্য সিজার করে। সরকারী চাকুরী, ওনি তো ধোয়া তুলসির পাতা, টাকা ছাড়া কোন ফাইল সই করেন না। পুলিশ, সে-তো জনগণের সেবক, টাকার জন্য নির্দোষ ব্যক্তিকে ধরে হয়রানি আর টাকা আদায় করেন। আমি তো আম-জনতা, ঘুষ টুষ বুঝি না, শুধু মূল্যবান ভোটটা বিক্রি করে দিই।
পাঠক! আপনারা নিশ্চয়ই হবু চন্দ্র রাজার নাম শুনেছেন। রাজার চরণ যখন ধুলোয় লেপ্টে যাচ্ছিল তখন তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খোঁজা হচ্ছিল। হবু চন্দ্র মন্ত্রীর পরামর্শে একবার ঝাঁটা দিয়ে ধুলো দূর করার চেষ্টা করে রাজ্যকে ধুলোময় করে দেয়, আরেকবার পানি দিয়ে ধুলো দূর করতে গিয়ে রাজ্যকে কাঁদাতে ভরপুর করে দেয়। তখন এক মুচি এসে রাজাকে পরামর্শ দিল, রাজা মশায়, চামড়া দিয়ে আপনার দুটি চরণ ঢাকুন তবে, ধরণীকে আর ঢাকিবার নাহি হবে। রাজা রাজি হওয়ায় মুচি তাঁর পা দুটোকে চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে দিল, মানে তাঁকে জুতো পরিয়ে দিল। রাজার পায়ে আর ধুলো লাগল না। বাঁচিল হবু, রক্ষা পাইল ধরা। হবু রাজারা দ্রব্যমূল্যের দাম থেকে থেকে বাঁচতে রীতিরকম পা দুটো চামড়া দিয়ে মুড়িয়ে রেখেছেন। কিন্তু সাধারণ প্রজাদের খবর কি রাখুন?
একবার ওগান্ডার এক চোরকে সামান্য ম্যানহোলের ঢাকনা চুরির অপরাধে মৃত্যুদ- দেয়া হল। মৃত্যু পরোয়ানা প্রস্তুত এমন সময় চোর তার শেষ ইচ্ছা হিসেবে দেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার সুযোগ চাইল। যখন তাকে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নিয়ে আসা হলো তখন সে প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলল যে স্যার, আপনার সাথে দেখা করতে চাওয়ার একটাই কারণ তা হলো, আমার কাছে এমন একটা গাছের বীজ আছে যে গাছটা মনের সব ইচ্ছা পূরন করতে পারে। আমি আপনার জন্য এই গাছটা রোপণ করে দিয়ে যেতে চাই। প্রধানমন্ত্রী তাকে জিজ্ঞেস করল ‘তোমার চারা লাগাতে কত দিন লাগবে?’চোর উত্তর দিল, ‘এইতো স্যার, সাত দিন।’সাতদিন পর তাকে আবার মন্ত্রিসভায় হাজির করা হল। একজন জিজ্ঞেস করল, ‘তোমার চারার কী খবর?’ চোর বলল, ‘আসলে জমি তো রেডি কিন্তু বীজটা পরিপক্ক হতে আরও তিনদিন লাগবে।’ তিনদিন পর তাকে আবার হাজির করা হল। প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘বীজ রেডি তো এবার?’ চোর বলল, ‘স্যার জমি বীজ সবই রেডি কিন্তু আমিতো তা রোপণ করতে পারব না।’ প্রধানমন্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেন?’ চোর বলল, ‘এটা এমন একজনের হাতে রোপণ করতে হবে যে কোনদিন চুরি করেনি। না হলে এটা কার্যকারিতা হারাবে।’ সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী অর্থমন্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন বীজ রোপন করতে।। অর্থমন্ত্রী কাচুমাচু হয়ে বললেন, ‘স্যার সারা দেশের অর্থ নিয়ে আমার কাজ। এত কাজের মধ্যে দু’একটা তো এদিক সেদিক হতেই পারে।’ এরপর প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন পরিবহনমন্ত্রীকে। পরিবহনমন্ত্রী কাচুমাচু হয়ে বললেন, ‘স্যার, কত কত গাড়ি-ঘোড়া আমার প্রতিনিয়ত অনুমোদন দিতে হয়, এর মাঝে তো দু একটা এদিক সেদিক হতেই পারে।’ এরপর প্রধানমন্ত্রী নির্দেশ দিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীও কাচুমাচু হয়ে বললেন, ‘স্যার, এতো দেশের সাথে যোগাযোগ, এতো দেশে যাওয়া আসা, বাণিজ্য লেনদেন এর মধ্যে তো আমারও দু একটা এদিক সেদিক হতেই পারে।’ প্রধানমন্ত্রী এরপর যাকেই বলেন সেই এদিক সেদিকের দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যায়। হঠাৎ সবাই প্রধানমন্ত্রীকে ধরলেন, ‘স্যার, আপনিই রোপণ করুন না।’ তখন প্রধানমন্ত্রী বললেন, ‘তোমাদের তো দায়িত্ব ছোট ছোট, আমি পুরো দেশ চালাই। আমার কি একটু আধটু এদিক সেদিক হতে পারে না!’
তখন সবাই চুপ হয়ে গেল। হঠাৎ একজন বলে উঠলেন, ‘তাহলে স্যার, এই লোক তো সামান্য একটা ম্যানহোলের ঢাকনা চোর। একে মৃত্যুদ- দেয়া কি ঠিক? একে ছেড়ে দেয়া হোক। আরেকজন বললেন, ‘না একে ছেড়ে দেয়া যাবে না। তাহলে সে বাইরে গিয়ে সব ফাঁস করে দেবে।’ সবাই চিন্তায় পড়ে গেল একে নিয়ে কী করা যায়? তখন একজন বলল,-‘স্যার এক কাজ করুন। একে আমাদের মতোই একটা পদ দিয়ে আমাদের সাথে শামিল করে নেন।’ যেই ভাবা সেই কাজ, সেই চোর হয়ে গেল মন্ত্রীসভার সদস্য। এভাবেই মন্ত্রিসভা গঠিত হচ্ছে সারা দুনিয়ায়।
সমস্যাটা হলো, আপনারা যখন এর বিরুদ্ধে, ওর বিরুদ্ধে কথার ফুলঝুরি ছোটাচ্ছেন, তখন আমরা নিজের প্রাণটুকু নিয়ে কী করব, কার কাছে যাব, কোথায় পালাব, বুঝতে পারছি না। ইশপের গল্পের বৃদ্ধ ভেকের মতোই আমাদের বলতে হচ্ছে, আপনাদের জন্য যা ছেলেখেলা, আমাদের জন্য তা জীবনমরণ সংকট।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, কলাম লেখক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮, তাং-২৯.৩.২০২৩