এডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
কাক কাকের মাংস না খেলেও বাংলাদেশের সাংবাদিকরা সাংবাদিকদের মাংস খায়। প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি গ্রেফতার হওয়ার পর এ বিতর্ক আরও বেড়েছে। আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক সরগম হয়ে উঠেছে চায়ের দোকান থেকে খোদ সুধী মহলে। বিভিন্ন মিডিয়ার যুক্তিযুক্ত নানাবিধ বিষয় নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা এখনও চলছে। আমি তৃণমূলের একজন সাংবাদিক, সম্পাদক ও সাংবাদিক নেতা হিসেবে অনেকে এ বিষয়ে মন্তব্য, বক্তব্য জানতে চান। ধরে নিলাম। সরকারের অর্জনকে ম্লান করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে এমন প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। অনেকে চুয়াত্তরে বাসন্তির জাল পরা সেই ছবির সাথেও এর তুলনা করছেন। তবে বাংলাদেশে একটি সংবাদ প্রকাশে অসঙ্গতিকে কেন্দ্র করে একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তারের ঘটনাকে আমি রীতিরকম ভীতি প্রদর্শন হিসেবে দেখছি।সাংবাদিকদের পেশাগত ভুল-ত্রুটি শুধরানোর জন্য অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন উপায় আছে। আইনী পন্থায় এগোতে চাইলেও আছে একাধিক আইন। এমনকি একটি বিশেষ বিচারিক প্রতিষ্ঠানও রয়েছে। নাম তার প্রেস কাউন্সিল। যদিও এ প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে ‘কাজ নেই তো খই ভাজ’ প্রবাদ রয়েছে। কিন্তু সব বাদ দিয়ে বারবার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহারকে ‘উদ্দেশ্যমূলক’ বলে আমার কাছে মনে হচ্ছে।
‘নানা জনের নানা মত’ সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে একটি গল্প দিয়েই লেখাটি শুরু করছি। এক জমিদার তার এলাকায় শুধু একটি সুপেয় পানির জন্য পুকুরের ব্যবস্থা করেছিল। জমিদার তার প্রজাদের এক কলসি পানি দিতো আর তার বিনিময়ে এক আনা পয়সা নিতো। মৃত্যু শয্যায় জমিদার তার ছেলেদের বললো,"বাবারা, পানির বিনিময়ে পয়সা নিই বলে লোকে আমায় বাজে কথা বলে। তোমরা আমার মৃত্যুর পরে এমন কিছু করবে যেন লোকেরা আমায় ভালো বলে।’’ ছেলেরা বললো,"আব্বাজান চিন্তা করবেন না, আপনি নিশ্চিন্তে মরেন। জমিদারের মৃত্যুর পরে তার ছেলেরা প্রজাদের এক কলসি পানির বিনিময়ে তারা আর পয়সা নিত না; তবে প্রজাদের পাছায় একটা করে বেতের বাড়ি দিতো। বাড়ি খেয়ে সত্যিই প্রজারা জমিদারের প্রসংশা করে বলত যে, লোকটি বড় ভাল লোক ছিল। এক আনা করে পয়সা নিত কিন্তু মারতো না। গল্পটির শিক্ষণীয় বিষয় সাংবাদিকদের উপরই ছেড়ে দিলাম।
এবার আরেকটি গল্প দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। আমার চার বছর বয়সী ছোট ছেলেটি গোপাল ভাড়ের কার্টুন দেখতে বেশ অভ্যস্ত। ওর কারণে আমি নিজেই বেশ অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।
রাজ্যে ‘রোগীর চেয়ে ডাক্তার, কবিরাজ বেশি’ গোপাল ভাঁড়ের মুখে এমন অদ্ভূত কথা শুনে মন্ত্রী গোপাল ভাড়ের অপমানের সুযোগটি পেয়ে গেল। রাজদরবারে গোপালের বুদ্ধি ও কান্ডজ্ঞানকে বার বার চ্যালেঞ্জ করে হেরে যাওয়া মন্ত্রী মুহূর্তেই রাজার কান ভারী করে তুললো । রাজা বললেন- শোনো গোপাল, আমার রাজ্যে রোগীর চেয়ে ডাক্তার বেশি এই তথ্য প্রমাণ করতে না পারলে তোমাকে আমি নির্বাসনে পাঠাবো।
তিনদিন পর রাজসভায় ফিরলো গোপাল। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলো কী হয়েছিলো? গোপাল বললো, তার ‘আধ-কপালি’ হয়েছে। আধ-কপালি হলো কপালের অর্ধেক অংশ জুড়ে ব্যাথাবিষ বা যন্ত্রণাবিশেষ। উজির বললো, থানকুচির পাতা বেটে মধ ুদিয়ে বাসী পেটে দিনে ৩ বার; নাজির বললো, হাতিরসূড়ের পাতা রাতে পানিতে ভিজিয়ে সকালে ১ বার; সভাকবি বললো, দুবলো ঘাসের সাথে তমুক মিশিয়ে।এভাবে দেখা গেলো দরবারে উপস্থিত সকলেই কোনো না কোনো একটা পথ্য নির্দেশনা দিলেনই। এবার গোপাল ঝেড়ে কাশলোঃ দেখলেন তো রাজামশাই, দরবারে রোগী মাত্র আমি একজন, আর ডাক্তার, কবিরাজ সবাই । গল্পশেষ । শিক্ষণীয় হলো, এই পৃথিবীতে শক্তিবলয়কে তোষামোদ করে, কেউ মনোরঞ্জন করে, কেউ সেবা দিয়ে, কেউ বিনোদিত করে, আবার কেউবা গোপালের মতো ভাঁড়ামি ও বুদ্ধির গাদন খেলে বেঁচে বর্তে থাকে। বাকিরা মরে যায় বা মৃতবৎ বেঁচে থাকে। বেঁচে থাকার এই প্রচেষ্টাগুলোর মধ্যে কোনোটা কমপ্রোমাইজ , কোনোটা কৌশল। কারো কারো ভাষ্যে এটা হলো ‘কায়দা করে বেঁচে থাকা।’’ এ বেঁচে থাকাটা বড়ো দৃষ্টিনন্দন, ছান্দিক ও অনুকরণীয়। অসীম অনিশ্চয়তা ও অসহায়ত্ব নিয়ে ক্ষমতাহীনতার মধ্যে বেঁচে থাকার সেই কৌশল শিখতে গিয়ে আজ আমি বড়ই বেমানান। গতকালই যেই নারীটি পুরুষতান্ত্রিকতায় দলিত হয়ে কাঁদতো, সেই নারীই আজ ক্ষমতায়িত হয়ে ক্ষমতার দম্ভে বাবা বয়সি বৃদ্ধটিকে নিয়ম শেখাচ্ছে কানধরে উঠবোস করে!
রাজা বা গোপাল এখন নেই। তবে কুর্নিশবলয়টি আছেই। আদি থেকেই আছে। সবাই আনুগত্য চায়, ভক্তি চায়, অসহায়ত্ব চায়, নির্ভরতা চায়, পরাধীনতা চায়। তবে ক্ষমতাহীনতাকে মেনে ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা সত্যিই অসীম। গোপাল ভাঁড় বলেছিলেন, রাজ্যে ডাক্তারের চেয়ে রোগী বেশি, আমি বলি ক্ষমতাহীনদের চেয়ে ক্ষমতাবান বেশি। কারণ ক্ষমতাহীনেরা সবসময়ই যুদ্ধগুলোতে বিজয়ী হয়ে এসেছে। ক্ষমতাহীন, ক্ষমতাবান সকলের জন্যে শুভ কামনা। শুভ হোক আগামী দিনগুলো।
লেখকঃ বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি ‘দি ডেইলী অবজারভার’ পত্রিকার সাংবাদিক, কলাম লেখক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। ০১৭১৬৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com