বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ১১:২৪ পূর্বাহ্ন
এস এ এইচ ওয়ালিউল্লাহ
বছর ঘুরে শুরু হয়েছে রমজান। রমজান মাস মুসলমানদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ মাস। বহুযুগ আগ থেকেই অত্যন্ত উৎসাহ-উদ্দীপনা আর উৎসব আমেজের মধ্য দিয়ে রোজা পালন করে আসছে বাংলার মুসলমানরা। মূল ধর্মীয় আচার (রোজা-তারাবিহ-সাহরি-ইফতার) এক ও অভিন্ন হলেও সাংস্কৃতিক ভিন্নতার কারণে রমজানে এসব উদযাপনে বেশ বৈচিত্র্যতা লক্ষ্য করা যায়।
বিভিন্ন দেশ ও সংস্কৃতির মানুষ সাহরি আর ইফতার সাজিয়ে থাকে নিজেদের ঐতিহ্য ও রীতিনীতি অনুযায়ী। আমাদের বাংলাদেশও তার ব্যতিক্রম নয়। ছোলা-মুড়ি-পেঁয়াজু-চপ ইত্যাদি ছাড়া যেন ব-দ্বীপের মানুষেরা ইফতার কল্পনাই করতে পারেনা! আবার সাহরিতে নানাবিধ তরকারির সাথে একটু দুধভাত বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশে প্রচলিত রমজান সংস্কৃতির অন্যতম হচ্ছে সাহরিতে হাঁকডাক।
এইতো, একদশক পূর্বেও বাংলাদেশের শহর থেকে শুরু করে গ্রামাঞ্চল– প্রতিটি এলাকাতেই দলবেঁধে এলাকার যুবকরা প্রতিটি বাড়ির সামনে যেয়ে সেই বাড়ির পুরুষদের নাম ধরে ডাকতো। কোন বাড়িতে পুরুষ মানুষ না থাকলে অমুকের মা বা চাচি বলে ডাকতো; যতক্ষণ পর্যন্ত বাড়ির ভেতর থেকে কেউ উত্তর না দেয় ততক্ষন পর্যন্ত। টিনের যের (মুড়ির টিন), কাঁসার থালা ইত্যাদি বাজিয়ে গজল বা কাওয়ালী গেয়ে পাড়ায় পাড়ায় সাহরিতে ডাকাডাকি চলত। একবিংশ শতাব্দীর আকাশ-সংস্কৃতির এই যুগে স্মার্টফোনের আতিশয্যে বাড়ি বাড়ি যেয়ে হাঁকডাকের সংস্কৃতি এখন ইতিহাস হয়ে গেছে।
যুগের বিবর্তনে সাহরিতে ডাকার পদ্ধতিতেও এসেছে পরিবর্তন। এখন মসজিদের মাইকের মাধ্যমে অধিকাংশ এলাকায় সাহরিতে ডাকা হয়। তবে বিগত কয়েকটি বছর থেকেই এভাবে সাহরিতে হাঁকডাকের বিষয়টি নিয়ে কিছু মানুষ আপত্তি তুলছেন। সাথে যুক্ত হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল কিছু ইসলামিক বক্তার ফতোয়া। সব মিলিয়ে তারা এটাই প্রমাণ করতে চাইছেন– একবিংশ শতাব্দীর এই যুগে এভাবে মাইকে ডেকে শব্দদূষণ ঘটিয়ে অন্যান্য ধর্মাবলম্বী, অসুস্থ ব্যক্তি এবং শিশুদের ঘুমের ব্যাঘাত ঘটানো কোনোভাবেই কাম্য নয়।
তাদের জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, এ কথা বললেও অত্যুক্তি হবে না যে– রমজানের সাহরি পূর্ব সময়ে এই হাঁকডাক বিশ্বজুড়ে মুসলিম সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর বহু দেশে সাহরিতে বিভিন্ন মাধ্যমে মানুষদের জাগিয়ে তোলার সংস্কৃতি আধুনিক এই যুগেও চালু রয়েছে। মরক্কোতে একদল মানুষ সাহরিতে অন্যদের জাগিয়ে তোলার দায়িত্ব পালন করে। তাদেরকে ‘নাফর’ নামে ডাকা হয়। তারা মাথায় টুপি, পায়ে জুতা আর মরক্কোর ঐতিহ্যবাহী পোশাকে সজ্জিত হয়ে সুরেলা গলায় গান গেয়ে শহরের অলিতে গলিতে হেঁটে সাহরিতে মানুষকে জাগিয়ে তোলে।
সাহরীর সময় হলেই তুরস্কের অলিতে-গলিতে বেজে ওঠে ড্রামের শব্দ। মানুষকে সময়মতো জাগিয়ে দেবার জন্য একদল তুর্কি ড্রাম বাজিয়ে, গান গেয়ে ডাকাডাকি করে। তুরস্কের এ সংস্কৃতি বহু পুরনো। তাছাড়া রমজানে প্রতিদিন তিনবার (সাহরি খাওয়ার সময়, সাহরির শেষ সময় ও ইফতারের সময়) রাষ্ট্রীয়ভাবে তোপধ্বনি দেওয়া হয়। এই তোপধ্বনি দেওয়ার সময়েই মসজিদের মিনার গুলোতে জালানো হয় ঐতিহ্যবাহী কানদিল বাতি। ইরানের রমজান সংস্কৃতির অন্যতম ছিল ঢোল বাজিয়ে, গান গেয়ে সাহরিতে মানুষকে জাগিয়ে তোলা।
সিরজান অঞ্চলে তো রীতিমতো প্রতি বাড়ির দরজায় আলাদাভাবে টোকা দিয়ে তারা লোকদের জাগ্রত করত। বাড়ির মালিককে সম্ভাষণ করে আবৃত্তি করতো (রমজান গ্রীষ্মকালে হলে) ওহে বয়োজ্যেষ্ঠ! উঠুন, সাহরি খাই/ খাই বরফ, চিনি মিশ্রিত ফালুদা; আর তো সময় নেই! রমজান শীতকালে হলে বলতো, হে বয়োজ্যেষ্ঠ! উঠুন, সাহরি খাই/ খাই মধু মিশ্রিত মাখন-তেল; সময়তো আর নেই! আবার বুশেহর প্রদেশে এরা ‘দাম্মাম’ (একপ্রকারের তবলা) বাজিয়ে লোকদের জাগ্রত করতো। সেখানে এরা ‘দোম সাহরি’ নামে পরিচিত। তবে যুগের উৎকর্ষতার সাথে এসব সংস্কৃতি কিছুটা ফিকে হলেও মসজিদে ঘোষণা দিয়ে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের সতর্ক করার বিষয়টি এখনও চালু রয়েছে দেশটিতে।
মিশরীয়দের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের খবর বিশ্বজুড়ে পরিচিত। রমজান মাস ঘিরে তাদের থাকে জমকালো সব আয়োজন। অন্যান্য আয়োজনের সাথে সাহরির সময় সবাইকে জাগিয়ে দেওয়ার কাজে নিয়োজিত থাকে একদল মানুষ। মিশরে তাদেরকে ডাকা হয় ‘মেসেহারাতি’ নামে। এছাড়া মিশরেও বহু বছর ধরে তোপধ্বনির মাধ্যমে ইফতার ও সাহরির সময় জানান দেওয়ার বিষয়টি চালু রয়েছে। রাজধানী কায়রোর ঐতিহাসিক সালাহউদ্দিন দুর্গে সুলতান খাসকাদুমের তোপটি একাজে আধুনিক এ যুগেও ঐতিহ্য হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
লেবাননে তো ইফতারে কামান দাগিয়ে তীব্র আওয়াজ এর মাধ্যমে রোজাদারদের ইফতার এর সময় জানিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ লেবানিজ সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের পুরোনো এই রীতির নাম ‘মিদফা-আল-ইফতার’।
পৃথিবীর দেশে দেশে এরকম বহু সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য এখনো চালু রয়েছে রমজানের সাহরিতে মানুষদের জাগিয়ে তোলার জন্য।
একটা কথা বলা হয়ে থাকে, সংস্কৃতি ধর্মের চেয়েও শক্তিশালী! এদেশের মানুষ ইচ্ছা কিংবা অনিচ্ছায় ধর্মের ততটুকুই পালন করে, যতটুকু সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। মূলত সংস্কৃতির মধ্যে রয়েছে আমাদের জীবনাচার, আত্মপরিচয়। এই কারণেই জুম্মা এবং ঈদের নামাজে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের উপস্থিতি থাকে চোখে পড়ার মত। শবে বরাত বা শবে কদরে মসজিদ গুলোতে থাকে উপচে পড়া ভীড়। তেমনিভাবে রমজানে সাহরিতে মানুষকে জাগিয়ে তোলার বিষয়টিও বাঙালি মুসলমানদের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে। এখানে শুধু জাগ্রত করাই মূখ্য উদ্দেশ্য থাকে না, সাহরিতে উৎসবমুখর আমেজ সৃষ্টি করাও এভাবে ডাকাডাকির অন্যতম উদ্দেশ্য। পুরো এলাকাতে রোজা এসেছে এমন একটা আমেজ তৈরি হয়।
মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে এমন আমেজ তৈরির জন্য তাদের স্থানীয় সংস্কৃতির আলোকে নানাবিধ আয়োজন করা হয়। তেমনি আমাদের দেশেও এরকম আমেজ তৈরির আবেদন কমে যায়নি। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে এটার প্রয়োজনীয়তা এখনো ব্যাপক।বাংলাদেশে বহু প্রাচীন কাল থেকেই টিনের যের (মুড়ির টিন), কাঁসার থালা, ঢোল বা তবলা বাজিয়ে দলবেঁধে গজল- কাওয়ালী গেয়ে সাহরিতে ডাকাডাকির প্রচলন রয়েছে। অধিকাংশ মানুষই এটাকে সাহরির সৌন্দর্য মনে করে। নিঃসন্দেহে এটি উৎকৃষ্ট একটি কৃষ্টি বা সংস্কৃতির উপমা। যা বর্তমানে মাইকের মাধ্যমে ডাকা ও ইসলামী সঙ্গীত পরিবেশনে রূপান্তরিত হয়েছে। এগুলোকে উপেক্ষা বা অবজ্ঞা কোনটিই করার সুযোগ নেই।
অমুসলিম অধ্যুষিত এলাকা কিংবা হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকাতে সতর্ক দৃষ্টি দিতে হবে। তবে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অন্যান্য যেসকল দেশে মুসলিমদের সাথে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান রয়েছে সেখানে কারোর ধর্মীয় কোন আচার বা সংস্কৃতি পালনে অন্যরা কখনোই বাধা হয়ে দাড়ায় না। এদেশে হিন্দুদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব দুর্গাপূজা কিংবা দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলা মাগুরাতে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম বৃহত্তম উৎসব কাত্যায়নী পূজার দিনগুলোতে মুসলিমরা যেমন কখনোই তাদের উদযাপনে বাধা দেয় না, তেমনি হিন্দুরাও রমজানের সাহরিতে হাঁকডাকের বিষয়টি নিয়ে কখনো বিরূপ মন্তব্য করে না। কারণ এগুলা যার যার সংস্কৃতির অংশ হয়ে গেছে।
যুগ যুগ ধরে সকল ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের মানুষেরা রোজায় এভাবে ডাকাডাকি, পুজোর দিনগুলোতে লাগাতার ঢোলের শব্দ, মাইকে গান-বাজনা, দীর্ঘ রাত ব্যাপী মাইকে কীর্তন কিংবা ওয়াজ মাহফিল এসবের সাথে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। তুরস্ক, মিশরের মতো দেশগুলোতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস রয়েছে। রমজান মাসে তারাও রোজার সম্মানে প্রকাশ্য খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকে। অনেক খ্রিস্টান তো সারা দিন উপবাস থেকেও রোজার পবিত্রতা রক্ষা করেন। এমন ধর্মীয় সম্প্রীতি বাংলাদেশেও কম নেই।
আমি তো হিন্দু সম্প্রদায়ের একাধিক ব্যক্তির কথা বলতে পারব, যারা রমজান মাসে আমাদের সাথে উপবাস পর্যন্ত থাকেন! কাজেই রমজান কেন্দ্রিক মানুষকে প্রাণবন্ত রাখতে মাইকে ডাকাডাকি, গজল বা ইসলামী সংগীত গাওয়া বা বাজানো এগুলোতে কোন অসুবিধাই থাকার কথা না। এগুলো সংস্কৃতিরই অংশবিশেষ। যারা অসুস্থ রোগী কিংবা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের অসুবিধার মত ঠুনকো যুক্তি দেখিয়ে সাহরিতে ডাকাডাকির বিষয়টি বন্ধ করতে তৎপর হয়েছেন, তাদের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই– তুরস্ক কিংবা মিশরের তোপধ্বনির শব্দ অথবা লেবাননের কামান দাগানোর শব্দ বাংলাদেশের মাইকে হাঁকডাকের চাইতে কি কম? সেসব দেশে কি অমুসলিমরা নেই? কিংবা অসুস্থ রোগী?
সাহরিতে হাঁকডাকের মত বিষয়গুলো মূলত আমাদের আবহমান সংস্কৃতির সাথে যুগে যুগে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। বৃহত্তর স্বার্থে অনেক বিষয় মানিয়ে নিতে হয়। সাহরিতে ডাকাডাকির মতো সামাজিক সভ্য সংস্কৃতি ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া কখনোই বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। তাই অহেতুক বিতর্ক আর ফ্যাসাদ এড়িয়ে জয় হোক সম্প্রীতি। যুগ যুগ ধরে টিকে থাকুক বাংলার এসব ঐতিহ্য আর সংস্কৃতি।
লেখক: শিক্ষার্থী, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়