বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৩৯ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ায় আগমন বনাম দুধের মাছিদের আনাগোনা! জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত! ক্রেতা ঠকে গেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে যত আইনগত প্রতিকার! আইনে জামিন চর্চা বনাম বিচারকের পদত্যাগের দাবীতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ! নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের থেকেই ভিসি নিয়োগের অনুরোধ ইবি শিক্ষকদের সংবিধান সংস্কারঃ সংশোধন না-কি পুনর্লিখন?  সেনাবাহিনীর বিচারিক ক্ষমতাঃ আইন কি বলে? ভূমি অধিগ্রহণে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হলে কী করবেন? ইবির জিওগ্রাফী বিভাগ: শিক্ষার্থীদের কাছে দরখাস্ত দিয়ে পদত্যাগ করলেন সভাপতি যুগে যুগে দালাল সাংবাদিকদের করুন পরিণতি বনাম কিছু শিক্ষনীয় গল্প!
ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে খোকসার পতিতালয়-পতিতাবৃত্তি

ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে খোকসার পতিতালয়-পতিতাবৃত্তি

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

কুষ্টিয়ার খোকসা একটি প্রাচীন জনপদ। যতদুর শোনা যায় ‘খোকা শাহ’ নামের এক সাধকের নাম থেকে খোকসা নামের উৎপত্তি হয়েছে। আবার কারও কারও মতে ‘খোকসা’ নামক গাছ থেকে খোকসা শব্দের উৎপত্তি। তবে ‘খোকসা’ নামক গাছ অনেক আগেই বিলুপ্ত হলেও বর্তমান রংপুর অঞ্চলের কিছু কিছু এলাকায় খোকসা নামক গাছ এখনও আছে।

জীবনধারণের যতগুলি উপায় প্রাচীনতম, তার মধ্যে বেশ্যাবৃত্তি অন্যতম। ব্রিটিশ আমলের শুরুতেই খোকসার গড়াই নদীর তীরে অবস্থিত জানিপুর পুরাতন বাজারের পার্শ্বে গড়ে উঠে একটি পতিতালয়। সেসময় এখানে একটি ছোটখাট বন্দর ছিল। গড়াই নদীর বুক চিড়ে ষ্টিমার এসে ভিড়ত। শাল কাঠেব আড়ত ছিল। বাদাবন থেকে ধান আসত। ধানের হাট বসত নিয়মিত। গড়াই নদীর কড়াল গ্রাসে এসব বিলীন হয়ে গেলে ১৯৪০ সালের দিকে পতিতালয়টি স্থানান্তরিত হয়ে কালীবাড়িতে স্থাপিত হয়।

কুষ্টিয়ার প্রখ্যাত সাহিত্যিক ড. আবুল আহসান চৌধুরী কর্তৃক রচিত ‘অবিদ্যার অন্তঃপুরে, নিষিদ্ধ পল্লীর অন্তরঙ্গ কথকতা’ বইটিতে তিনি লিখেছেন ‘বেশ্যাবাজি ছিল বাবু সমাজের সাধারণ ঘটনা। নারী আন্দোলনের ভারত পথিক রাজা রামমোহন রায়েরও রক্ষিতা ছিল। এমনকি ওই রক্ষিতার গর্ভে তার একটি পুত্রও জন্মে ছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর পতিতা সুকুমারী দত্তের প্রেমে মজেছিলেন। সাহিত্যিক মীর মোশাররফ হোসেন নিয়মিত বেশ্যা পাড়ায় যেতেন তা তিনি নিজেই তার ডাইরিতে লিখে গেছেন। মরমি কবি হাসন রাজা, কথা শিল্পী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় নিয়মিত পতিতালয়ে যেতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পতিতালয়ে যেতেন। নিষিদ্ধ পল্লীতে গমনের ফলে রবীন্দ্রনাথের সিফিলিস আক্রান্ত হওয়ার খবর তার জীবদ্দশাতেই ‘বসুমতী’ পত্রিকাতে প্রকাশিত হয়েছিল।

”সব যুগে, সব সভ্যতায়, বেশ্যাদের নিন্দা করা হয়েছে। আবার তাদের প্রতি মুগ্ধতায়ও ছড়িয়ে রয়েছে সমাজের সর্বস্তরে। খোকসার মানুষ হিসেবে সেসময় যৌনপেশায় নিয়োজিত মানুষগুলো, তাদের সুখ-দুঃখ, কাজের পরিবেশ জানতে ও জানাতেই আমার ছোট্র এই নিবন্ধ। তবে বেশ্যাদের জীবনসত্য থেকে যায় আলো-অধারীতে।”

বিভিন্ন সূত্র থেকে আহরিত তথ্য রয়েছে এ নিবন্ধে। শিরোনাম বিষয়ে এমন পূর্ণাঙ্গ আলোচনা এই প্রথম বলে দাবীও রাখি।পতিতাবৃত্তির অপর নামসমূহ গণিকাবৃত্তি, যৌনবৃত্তি, বেশ্যাবৃত্তি ইত্যাদি। ইতিহাসের আদিকাল থেকে এদের বিভিন্ন নামেও ডাকা হয়। যেমন- দেহপসারিণী, বেশ্যা, রক্ষিতা, খানকি, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, বিজজব্রা, অসোগু, গণিকা, কুলটা, বারণবণিতা, কুম্ভদাসী, নটি, রূপজীবা ইত্যাদি। এ পেশায় নিয়োজিতরা নিজদেহ নিয়ে ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করে। অর্থাৎ নিজদেহ স্বেচ্ছায় অপরকে ভোগ করার সুযোগদানের বিনিময়ে অবৈধপন্থায় অর্থোপার্জন। জর্জ স্কট তার ‘পতিতা বৃত্তির ইতিহাস’ নামক বইয়ে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন- ‘পতিতারা হলো সেই সম্প্রদায়ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে।’ অক্সফোর্ড ডিকশনারি মতে বেশ্যা হলো একজন নারী যে তার দেহ ভাড়া দেয় যথেচ্ছ যৌন-সংসর্গের জন্য।

আদিম যুগ থেকে যৌনমিলনের মধ্যে দিয়ে ঈশ্বর সাধনার পথে মানুষ যাত্রা শুরু করেছে। নিজেদের শরীরই ছিল তাদের প্রথম ও প্রধান উপাচার। যে কথা বলছিলাম স্থানান্তরের পর নতুন স্থানে জৌলুস হারায় বেশ্যাবৃত্তি। খোকসার কালীমন্দিরে ঢুকতেই শচীন মাষ্টারের যে বর্তমান বাড়ি সেখানেই নতুন করে গড়ে উঠে পতিতালয়টি। মাত্র ১৫-২০ কাঠা জমির উপর। সেসময় ঘর ছিল মাত্র ১০-১৫টি। পতিতাদের সংখ্যা ছিল মাত্র ২০-২৫ জন। কুমুদিনী নামক একজন যৌনকর্মী বাড়িওয়ালা হিসেবে সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। ১৯৬৯ সালের দিকে কিছু ধর্মপ্রাণ মানুষ ও মুসলিমলীগের কু দৃষ্টি পড়ে এ বেশ্যালয়ের উপর। অবশেষে উচ্ছেদ করতে সক্ষম হয়। খোকসার বেশ কিছু মানুষ ওই সব পতিতাদের স্ত্রী করে ঘরে তুলে নেন। সামাজিক নিরাপত্তার কথা ভেবে পতিতালয় উচ্ছেদকারী জামাত নেতা ও পতিতাদের স্বামীর নাম প্রকাশ করা হলো না।

বাংলা পিডিয়া তথ্য সূত্র মতে মহাভারতে উল্লেখ আছে, একজন বেশ্যা ভালো প্রকৃতির হলে উচ্চতর জীবনে পুনর্জন্ম লাভ করতে পারে। এ জীবিকা সম্পর্কে বৌদ্ধ ধর্মেরও একই মত। মহাভারতের যুগে অপরাপর সম্মানজনক বৃত্তিগুলোর মধ্যে পতিতা বৃত্তিই ছিল অন্যতম। রাজদরবারে ও বিবিধ রাজকীয় অনুষ্ঠানে পতিতাদের উপস্থিতি ছিল অপরিহার্য। বিশিষ্ট প্রত্নতত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদ ড. অতুল সুর তার দেবলোকের যৌনজীবন বইয়ের ৬২ পৃষ্ঠায় লিখেছেন ‘মৈথুন ধর্মটাই সেকালের সনাতন ধর্ম ছিল’।

রোমান ইতিহাস মতে, পৃথিবীতে প্রথম বেশ্যাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই। সপ্তম শতকের রাজা হর্ষবর্ধনের সভাকবি ছিলেন বানভট্ট। বানভট্ট তার ‘কাদম্বরী’ গ্রন্থে লিখেছেন, সেকালে বেশ্যারাই দেশের রাজাকে স্নান করাতো। এমনকি রাজার পরনের সব পোশাক বেশ্যারাই পরিয়ে দিত।

অবশেষে বাড়িওয়ালা কুমুদিনী দেবী এসে আশ্রয় নেন খোকসা থানার পাশে বর্তমান যে স্থানটি ফিটুর মেস নামে পরিচিত। পরবর্তীতে ওই জমিটি কিনে নেন জনৈক আমজাদ হোসেন নামে এক ব্যক্তি। এভাবে খোকসার পতিতাবৃত্তির ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটে।

ডা. লুৎফর রহমান তার ‘মহাজীবন’ গ্রন্থে লিখেছেন ‘এই সমাজে যদি তাদের (গণিকাদের) প্রয়োজন নাই থাকত তাহলে তারা অনেক আগেই হারিয়ে যেত।’ প্রবীর কুমার চট্টোপাধ্যায় রচিত ‘কালিকা পুরোনোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি’ বইয়ের ৭২, ৮৬, ১০৮, ১২৭ পৃষ্ঠায় প্রকাশিত, হিন্দুরা মনে করে, বেশ্যারা এ সমাজকে নির্মল রাখে। আর সেই কারণেই দুর্গাপূজার সময় বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য। দুর্গাপূজার সময় দশ ধরনের মাটি প্রয়োজন হয়। তার মধ্যে বেশ্যার দরজার মাটি অপরিহার্য।

অবশেষে যে কথা দিয়ে শেষ করতে চাই। বেশ্যাদের অমর্যাদা দূর করতে কি বেশ্যাবৃত্তি পেশাটাকেই মুছে দেওয়া দরকার ছিল সে সময় জামায়াত নেতাদের, না নিষ্পেষণ দূর করে, তাদের কাজকে অন্য পাঁচটি পেশার মতো মর্যাদা দেওয়াটা জরুরী ছিল। পাঠকই এর জবাব দেবেন।

লেখক: আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট, আইন গ্রন্থ প্রণেতা, সাংবাদিক ও কলামিস্ট। 

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel