বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৩ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
কেউ যদি আপনাকে মিথ্যা মামলায় জড়িত করে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন করেন, তাহলে আপনি সেই মিথ্যা মামলা দায়েরকারী বাদীর বিরুদ্ধেও মামলা করে প্রতিকার পেতে পারেন। এমনকি মিথ্যা মামলা দায়েরকারীর জেল, জরিমানার ব্যবস্থাও করতে পারেন। কিন্তু এ মানহানি মামলাটি কখন, কোথায়, কিভাবে করতে হয়- তা নিয়েই আজকের নিবন্ধ।
মিথ্যা মামলার দায় থেকে আপনি যখন অব্যহতি পাবেন কিংবা বিচারিক কার্যক্রম শেষে মাননীয় আদালত যখন আপনাকে খালাস দেবেন কিংবা মামলার তদন্তকারী অফিসার তদন্ত শেষে ঘটনার সত্যতা না পেলে ওই মামলায় আপনার পক্ষে ফাইনাল রিপোর্ট দেবে, তখন ওই মামলাটিকে মিথ্যা মামলা দাবী করে আপনি বাদীর বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে পারেন। মনে রাখবেন মিথ্যা মামলায় আপনি মুক্তি কিংবা খালাস না পেলে কিন্তু এ মানহানি মামলা করতে পারবেন না।
আর ম্যাজিস্ট্রেট যদি মিথ্যা মামলা দায়েরকারী বাদীর বিরুদ্ধে আপনার অভিযোগের পর কোন ব্যবস্থা না নেন, তাহলে আপনি ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৭৬ বি ধারা অনুযায়ী দায়রা আদালতে আপিল দায়ের করতে পারবেন। এতে ফল না পেলে মহামান্য হাইকোর্টেও রিভিশন করতে পারবেন। তবে এরকম মিথ্যা মামলায় ম্যাজিস্ট্রেটের কিন্তু ম্যাজিক্যাল পাওয়ার আছে। তিনি অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথেই ফৌজদারী কার্যবিধির ২৫০ ধারার বিধান মতে মিথ্যা অভিযোগকারী বাদীর বিরদ্ধে ৫০০ বা ১০০০/-টাকা ক্ষতিপূরণের আদেশ দিতে পারেন। ক্ষতিপূরণের টাকা পরিশোধ না করলে ৩০ দিনের জেল দিতে পারবেন। আবার ফৌজদারী কার্যবিধির ২০৫(৫) ধারা অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেট ৬ মাসের কারাদন্ড বা ৩০০০/- টাকা জরিমানাও করতে পারেন। আবার ম্যাজিস্ট্রেট কিংবা দায়রা আদালত নিজেও ফৌজদারী কর্যিবিধির ১৯৫ ধারার বিধান অনুযায়ী মিথ্যা মামলা দায়েরের অভিযোগটি আমলে নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতেও পাঠাতে পারেন। কাজেই বিচারক নিজে স্বপ্রণোদিত হয়েই বাদীর বিরুদ্ধে ফলস প্রসিকিউশন দায়ের করতে পারেন।
বিচারক কোন পদক্ষেপ না নিলে ক্ষতিগ্রস্থ পক্ষ অর্থাৎ আসামীর দরখাস্তের পরিপ্রেক্ষিতে মামলাটি আমলে নিতে পারবেন। মিথ্যা মামলা সাজা দেয়ার বিষয় বলা আছে দন্ডবিধির ২১১ ধারায়। মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ১০ বছরের অধিক সাজা হতে পারেন এমন অপরাধের মিথ্যা মামলার সাজা হলো ৭ বছরের কারাদন্ড। এই তিন প্রকার অপরাধ ব্যতীত অন্য ধরনের ক্রিমিনাল অপরাধের জন্য মিথ্যা মামলার সাজা হলো ২ বছরের কারাদন্ড। আর মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য সাক্ষীর শাস্তি দিতে হলে মিথ্যা মামলায় খালাস আদেশ পাওয়ার পর আদালতে আবেদনের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবেন। দন্ডবিধির ১৯৩ ধারা অনুযায়ী মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদানকারীর ৭ বছর পর্যন্ত কারাদন্ড আর মিথ্যা সাক্ষ্যের জন্য যদি আসামীর মৃত্যুদন্ড হয়, তাহলে মিথ্যা সাক্ষ্যদানকারী ব্যক্তিরও দন্ডবিধির ১৯৪ ধারা অনুযায়ী মুত্যুদন্ড শাস্তি হতে পারে। আবার ১৮ বছরের নিচে অর্থাৎ শিশুর বিরুদ্ধে কেউ মিথ্যা মামলা দায়ের করলে শিশু আইন, ২০১৩ এর ৮৩ ধারার বিধান অনুযায়ী
মিথ্যা তথ্য প্রদানকারীর বিরুদ্ধে ২৫ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদান ও ৬ মাসের জেলের বিধান করা হয়েছে। তবে শিশু আদালতের বিচারক নিজে এ শাস্তি প্রদান করবেন না। তিনি শাস্তির জন্য চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রসিকিউশনের জন্য পাঠিয়ে দেবেন। এমনকি কেউ যদি গ্রাম আদালতে কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে, তাহলে গ্রাম আদালত আইন, ২০০৬ এর ৯(ক) ধারায় ৫০০০/ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারেন। আর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে কেউ যদি মিথ্যা ধর্ষণ কিংবা অন্য কোন মামলা দায়ের করে তাহলে এ আইনের ১৭ ধারার বিধান মতে বাদীর শাস্তি ৭ বছর। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হচ্ছে ট্রাইব্যুনাল স্বপ্রণোদিত হয়ে মিথ্যা মামলার অভিযোগ আনয়ন করতে পারবেন না। আসামীকেই অভিযোগ আনয়ন করতে হবে।এছাড়া টর্ট আইন অনুসারে বিদ্বেষ পরায়ণ মামলার ক্ষেত্রে প্রতিকার পেতে চাইলে বাদীকে প্রমাণ করতে হবে যে, বিবাদী তার বিরুদ্ধে যুক্তিসংগত এবং সম্ভাব্য কারণ ছাড়া বিদ্বেষবশত মামলাটি করায় বাদীর ক্ষতি হয়েছে।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email: seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮