শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:১৯ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবে যা করণীয় জমি আপনার, দখল অন্যের! কী করবেন? রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান, আইনী নৈরাজ্য ও অতীত ইতিহাস! শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির মিথ্যাচার বনাম সাংবিধানিক সমাধান! সহায় সম্পত্তি পুণ্যের কাজে ওয়াক্ফ গঠন ও প্রাসঙ্গিকতা! শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামেঃ লালন কি জাত সংসারে— রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ায় আগমন বনাম দুধের মাছিদের আনাগোনা! জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত! ক্রেতা ঠকে গেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে যত আইনগত প্রতিকার! আইনে জামিন চর্চা বনাম বিচারকের পদত্যাগের দাবীতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ!
সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত নিয়ে বিরোধ, আইন কী বলে?

সন্তানের অভিভাবকত্ব ও হেফাজত নিয়ে বিরোধ, আইন কী বলে?

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
নাবালকের ‘হিজানাত’ বা হেফাজতকারী হচ্ছে পুত্র সন্তানের ৭ বছর বয়স না হওয়া পর্যন্ত এবং কন্যা সন্তানের বালেগা না হওয়া পর্যন্ত মাতা তাদের শরীরের হেফাজত করার অধিকারী। মাতা তালাকপ্রাপ্তা হলেও এ অধিকার অব্যাহত থাকে। এ অধিকারকে ‘হিজানাত’ বলে। তবে পিতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে মা নাবালক সন্তানকে যেখানে সেখানে রাখতে পারবে না। এমনকি তার যতেœর অবহেলা করতে পারবে না।

আর নাবালক সন্তান সন্ততির প্রাথমিক ও স্বাভাবিক অভিভাবক হচ্ছে তাদের পিতা। মাতার হেফাজত পিতার নিয়ন্ত্রণ সাপেক্ষে এবং মাতা শুধু তাদের দেহের হেফাজত করে থাকেন, সম্পত্তি তত্বাবধানের অধিকার তার নেই। সম্পত্তিসহ নাবালকের সকল কিছুর উপর পিতার নিয়ন্ত্রণ থাকবে এবং তিনি এগুলোর প্রকৃত অভিভাবক।

যখন কোনো নাবালকের মা মারা যান বা কোনো কারণে নাবালকের জিম্মাদারিত্বের অধিকার হারিয়ে ফেলেন সে ক্ষেত্রে নিচের মহিলা আত্মীয়রা জিম্মাদারের দায়িত্ব পাবেন। ১. মায়ের মা ২. পিতার মা ৩. সহোদর বোন ৪. বৈপিত্রেয় বোন (সৎ মায়ের সন্তান), ৫. বৈমাত্রেয় বোন, ৬. সহোদর বোনের মেয়ে ৭. বৈপিত্রেয় বোনের মেয়ে, ৮. বৈমাত্রেয় বোনের মেয়ে, ৯. মায়ের বোন, ১০. পিতার বোন। উপরোল্লিখিত মহিলারা না থাকলে নাবালকের যারা অভিভাবক হতে পারেন, তারা জিম্মাদারিত্বের অধিকার পাবেন। অর্থাৎ ১. বাবা, ২. নিকটতম দাদা, ৩. পূর্ণ ভাই (যাদের বাবা-মা এক), ৪. পূর্ণ ভাইয়ের ছেলে, ৫. রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে, ৬. উত্তরাধিকারে বাবার বংশের সমান শ্রেণীভুক্ত অন্যান্য আত্মীয়, যেমন-চাচা।

নাবালকের বিষয় সম্পত্তির অভিভাবক হবেনঃ ১। পিতা, ২। পিতা কর্তৃক উইল দ্বারা নিযুক্ত ব্যক্তি, ৩। পিতার পিতা (দাদা, পিতামহ), ৪। পিতামহ কর্তৃক উইল দ্বারা নিযুক্ত ব্যক্তি

যে সকল কারণে মা তার জিম্মদারিত্বের অধিকার হারান, তার মধ্যে অন্যতম হলো-
১. নীতিহীন জীবনযাপন করলে
২. যদি এমন কারো সঙ্গে তার বিয়ে হয় যিনি শিশুটির নিষিদ্ধ স্তরের মধ্যে ঘটলে তার ওই অধিকার পুনর্জীবিত হয়
৩. সন্তানের প্রতি অবহেলা করলে ও দায়িত্ব পালনে অপারগ হলে
৪. বিয়ে থাকা অবস্থায় বাবার বসবাসস্থল থেকে দূরে বসবাস করলে
৫. যদি সে ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করে
৬. যদি সন্তানের পিতাকে তার জিম্মায় থাকা অবস্থায় দেখতে না দেয়।

নাবালকের তত্ত্বাবধান ও অভিভাবকত্বের জন্য পাস করা হয়েছে অভিভাবকত্ব ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০, যা মূলত গার্ডিয়ানশিপ অ্যাক্ট নামেই পরিচিত। ১৮৭৫ সালের সাবালকত্ব আইনের বিধান অনুসারে ১৮ বছর পূর্ণ হলে নাবালকত্বের অবসান ঘটে। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুসারে ১৬ বছরের কম বয়সের সব ব্যক্তি নাবালক। ১৯২৯ সালের বাল্যবিবাহ নিরোধ আইনে পুররুষের ক্ষেত্রে ২১ বছরের নিচে এবং স্ত্রীর ক্ষেত্রে ১৮ বছরের নিচের ব্যক্তিকে নাবালক বলা হয়েছে। শিশু আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী ১৬ বছরের নিচের ব্যক্তি নাবালক এবং ১৭ বছরের নিচে সব ব্যক্তিকে যুবক বলা হয়েছে। দন্ডবিধির ৩৬১ ধারামতে, পুরুষের ক্ষেত্রে ১৪ বছর এবং নারীর ক্ষেত্রে ১৬ বছরের কম বয়স্করা নাবালক।

অভিভাবকত্বের প্রকারভেদের মধ্যে রয়েছে ১। স্বাভাবিক অভিভাবক, ২। বাবা কর্তৃক উইল দ্বারা নিযুক্ত অভিভাবক; ৩। গার্ডিয়ানস এন্ড ওয়ার্ডস অ্যাক্ট ১৮৯০ অনুযায়ী আদালত কর্তৃক নিযুক্ত অভিভাবক। এছাড়া ‘কার্যত অভিভাবক’ হিসেবেও অভিভাবক দেখা যায়।

যদি কোনো নাবালকের স্বাভাবিক অভিভাবক থেকে থাকে, তবে আদালতের মাধ্যমে অভিভাবক নিয়োগের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে স্বাভাবিক অভিভাবক তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে বা স্বাভাবিক অভিভাবকের মৃত্যু হলে অভিভাবকত্বের অধিকার নিয়ে মা-বাবা বা দাদা বা নানি-বাবার মধ্যে মতবিরোধ সৃষ্টি হলে ও সন্তানের অভিভাবকত্ব দাবি করে একাধিক আবেদনপত্র জমা হলে আদালত সমগ্র পরিস্থিতির পর্যবেক্ষণ শেষে নাবালকের কল্যাণের জন্য উপযুক্ত বলে বিবেচিত ব্যক্তিকে অভিভাবক নিয়োগ করবে। সন্তানের সম্পত্তির অভিভাবকত্বের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে প্রচলিত মুসলিম আইন ৩ ধরনের অভিভাবকত্ব স্বীকার করে। নাবালকের কোর্ট গার্ডিয়ান নিয়োগ বাধ্যতামূলক। যদি তা না করা হয় তাহলে বাদী মোকদ্দমায় ডিক্রি পেলেও নাবালক উক্ত মোকদ্দমায় সহ বিবাদী থাকলে বা নাবালকের স্বার্থ হানি না হলে উক্ত ডিক্রি বাতিল হবে না। ( ৪২ ডিএলআর ১৯৯০)।

একজন আইনগত অভিভাবক নাবালকের খাদ্য, বস্ত্র বা লালন-পালনের মতো অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনে নাবালকের জিনিসপত্র ও অস্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় বা বন্ধক দিতে পারেন। এ ছাড়া একজন আইনগত অভিভাবক শুধু নিম্নলিখিত এক বা একাধিক কারণে নাবালকের স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয় করতে পারেন যথা ১. ক্রেতা দ্বিগুণ মূল্য দিতে প্রস্তুত, ২. সম্পত্তিটি ধ্বংসের পথে, ৩. যদি সম্পত্তির ব্যয় তার আয়কে ছাড়িয়ে যায়। তবে এ জাতীয় বিক্রয় কেবল নাবালকের ভরণপোষণ বা উইলের দাবি পরিশোধ, ঋণ বা ভূমি কর পরিশোধের জন্যই করা যেতে পারে, ৪. সম্পত্তি অন্যায়ভাবে গ্রাস হওয়ার সম্ভাবনা থাকলে।

উল্লেখ্য, সম্পত্তি হস্তান্তর সংক্রান্তে মাতা নাবালক সন্তানের কার্যকরী অভিভাবক নন। (৪৬ ডিএলআর ৮৬)। কারণ আদালতের অনুমোদন ছাড়া অভিভাবিকা মাতাও জমি বিক্রয় করতে পারে না। (১৫ বিএলটি ৪১৬)।

উপরোক্ত আইনগত অভিভাবকদের অনুপস্থিতিতে সন্তানের সম্পত্তির অভিভাবকদের জন্য আদালত কর্তৃক কোনো যোগ্য ব্যক্তিকে নাবালকের সম্পত্তির তত্ত্বাবধানের জন্য নিযুক্ত অভিভাবক আদালতের অনুমতি ছাড়া নাবালকের স্থাবর সম্পত্তি কোনো অংশ বন্ধক দিতে বা বিক্রয়, দান, বিনিময় বা অন্য কোনো প্রকারে হস্তান্তর করতে পারেন না।

অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন, ১৮৯০-এর ১৯ ধারায় অভিভাবক হিসেবে পিতাও অযোগ্য হতে পারেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, যদি বাবা চারিত্রিকভাবে অসৎ হন, সন্তানের মা অর্থাৎ স্ত্রীর প্রতি নিষ্ঠুরতা করেন, মাদকাসক্ত এবং অধার্মিক হন, শিশুদের প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ করেন, প্রকাশ্যে লাম্পট্য করেন, দুস্থ অথবা নিঃস্ব হন অথবা স্বামী ও স্ত্রীর মাঝে এ সংক্রান্ত কোনো চুক্তি থাকে, বাবা পুনরায় বিয়ে করেন এবং নাবালক সন্তানের ভরণপোষণ দিতে অবহেলা করেন।

মুসলিম আইন অনুযায়ী মা যদিও স্বাভাবিক অভিভাবক নন, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি অভিভাবকত্বের আবেদন করতে পারেন, যেমন- মা যদি দেখেন সন্তানের প্রকৃত অভিভাবক যিনি, তিনি ঠিকমতো দেখাশোনা করছেন না বা দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হচ্ছেন তবে মা নিজ সন্তানের প্রকৃত কল্যাণের জন্য তার কাছে সন্তান থাকা উচিত মর্মে অভিভাবকত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য আবেদন করতে পারেন। ছেলে সন্তানের ৭ বছর পূর্ণ হলে এবং কন্যা সন্তানের বয়ঃসন্ধিকালে পৌঁছলে নিম্নোক্ত ব্যক্তিরা অভিভাবকত্বের অধিকার পেতে পারেন। ১. বাবা, ২. বাবা কর্তৃক সম্পাদিত উইলে সন্তানের অভিভাবকত্ব যে ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে, ৩. বাবার বাবা যত ওপরেই হোক, ৪. আপন ভাই, ৫. রক্ত সম্পর্কের ভাই, ৬. আপন ভাইয়ের ছেলে, ৭. রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে, ৮. বাবার আপন ভাইয়ের ছেলে, ৯. বাবার রক্ত সম্পর্কীয় ভাইয়ের ছেলে। যে ক্ষেত্রে এ রকম কোনো আত্মীয়ও নেই, সে ক্ষেত্রে আদালত তার স্ববিবেচনামূলক ক্ষমতাবলে যে কাউকে নাবালক, নির্বোধ, উন্মাদ বা অপ্রকৃতিস্থ ব্যক্তির অভিভাবক নিয়োগ করতে পারে।

লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইনের শিক্ষক ও আইন গবেষক। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel