শনিবার, ০২ নভেম্বর ২০২৪, ১২:২৬ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
আইনাঙ্গনে বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী, পুলিশ ও বিচার কাজের সাথে সম্পৃক্ত প্রায় সকলের কাছে মাদককে ‘মাল’ বলে অভিহিত করা হয়। কথোপকথনে শোনা যায়- কত পিছ মাল, কত বোতল মাল, কতটুকু মাল, কি জাতীয় মাল, মালের পরিমান কত ইত্যাদি। ঈনশার তালিকায় নিত্য-নতুন ‘মাল’ যুক্ত হচ্ছে। সেই ‘মাল’কে সংযুক্ত করে আইন হচ্ছে। কঠিন সব ধারা যুক্ত করা হচ্ছে আইনে। বিচারিক জটিলতা দেখা দিলে আইনে সংশোধনীও আনা হচ্ছে। কিন্তু যে ‘মাল’ নিয়ে মামলা হচ্ছে, পুলিশ, র্যাব, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর হাফিয়ে উঠছে-সেই ‘মাল’ এর কদর আমরা নিচ্ছি না। ফলে মাদক মামলার আসামীরা সহজেই পার পেয়ে যাচ্ছে। আমাদের ফৌজদারী কার্যবিধির ৫১৬(এ) ধারার বিধান মতে ‘মাল’ জব্দ করতে হয়। ‘মাল’ জব্দ নিয়ে রয়েছে নানা জটিলতা। প্রথমত: ‘মাল’ জব্দ করতে হবে স্থানীয় গন্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতে, দ্বিতীয়ত: মালের তালিকায় তাদের স্বাক্ষর নিতে হবে এমনকি তালিকা চাইলে তা সরবরাহ করতে হবে, তৃতীয়তঃ জব্দকৃত মালের নমুনা আলাদা করতে হবে এবং সেগুলোকে জব্দকারী অফিসার ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য যুক্ত লেভেল দ্বারা সিলগালা করতে হবে যাতে পরবর্তীতে এগুলোর মধ্যে কোনরুপ অপরাধমূলক দ্রব্য প্রবেশ করানো না যায়। চতুর্থত: জব্দকৃত কথিত ‘মাল’ থানার অফিসার-ইন চার্জ এর নিকট জমা দিতে হবে এবং সেগুলো অবশ্যই থানার প্রপার্টি রেজিষ্টারে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। তবে মালের পরিমাণ বেশী হলে কিংবা অন্য কোনো কারণে সংরক্ষণ করা অসুবিধাজনক হলে আদালতের অনুমতি নিয়ে সেগুলো ধ্বংস করা যাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর সেকশন ২৯(২) ধারা মতে। আর যদি এমন হয় যে, মালের পরিমাণ এত বেশী যে যেগুলো থানা পর্যন্ত পরিবহন করা অসুবিধাজনক, সেক্ষেত্রে ঘটনাস্থলেই সেগুলো ধ্বংস করা যাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ এর সেকশন ২৯(৩) ধারা মতে। মাল ধ্বংসের পর ঘটনাস্থলেই জব্দকৃত নমুনা আলামত আদালতের অনুমতি নিয়ে পিআরবি ৫২২ রেগুলেশন এর বিধান অনুসারে রাসায়নিক প্রতিবেদনের জন্য পাঠাতে হবে। পঞ্চমত: কিছু আলামত আদালতে প্রদর্শনীর জন্য কোর্ট মালখানায় প্রেরণ করতে হবে এবং যে নম্বরে মালখানায় কথিত বস্তুগুলো গ্রহণ করেছেন সেই কোর্ট মালখানা রেজিস্টার (সিএমআর) অভিযোগ পত্রের ৬ নং কলামে উল্লেখ করতে হবে। কোর্ট মালখানায় প্রেরিত কথিত মাদকদ্রব্যগুলো যথাযথ প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য আইনের ৬০ ধারার বিধান অনুসারে বিচারিক আদালতের পরিদর্শনের জন্য উপস্থাপন করতে হবে।
কিন্তু দুঃখের সাথে জানাতে হয়, ফৌজদারী কার্যবিধি’র ১০৩ ধারা ও পিআরবি’র ২৮০ এর বিধান না মেনে ‘মাল’ নিয়ে চলে শুধু তেলেসমাতি। ষষ্ঠত: ‘মাল’ যার নিকট থেকে উদ্ধার করা হলে, মালের জব্দ তালিকায় তার স্বাক্ষর থাকার কথা থাকলেও মালের মালিকের সই থাকছে না। যার সুযোগ বিচারে গিয়ে মালের মালিক নিচ্ছে। তেমনিভাবে ফৌজদারী কার্যবিধি’র ১০৩ ধারার বিধানমতে যাদের উপস্থিতিতে মালের তালিকা হওয়ার কথা, তাদের সামনে না হয়ে হচ্ছে পথচারীদের সামনে। মালের উদ্ধারের প্রমাণ হিসেবে পথচারীদের ডেকে একটি সাদা কাগজে স্বাক্ষর নেয়া হচ্ছে। ফলে জব্দ তালিকার সাক্ষী হিসেবে ওই পথচারীকে যখন আদালত ডাকছে, তখন রীতিরকম পথচারী সাক্ষ্য দেয় যে, মাল উদ্ধার দেখেনি কিংবা জব্দ তালিকায় স্বাক্ষর করেননি; শুধুমাত্র পুলিশের কথামতো সাদা কাগজে স্বাক্ষর করেছি। জব্দ তালিকার কথিত সাক্ষী আদালতে এরকম সাক্ষ্য প্রদানের পর মালের উদ্ধার রীতিরকম আদালত, রাষ্ট্রপক্ষ, বিচারপ্রার্থী, আইনজীবী’র কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠে। ফলে মালের বিচার বিপন্ন হয়ে উঠে।
ধরুন, পুলিশ অভিযান চালিয়ে ১০০০ পিচ ইয়াবা উদ্ধার দেখিয়ে ৫ পিছ রাসায়নিক পরীক্ষার জন্য আর মাত্র ২০ পিছ কোর্টের মামলখানায় পাঠিয়ে দিল। এতে পুলিশ আসামীর খালাসের পথ তৈরী করে দিল। কারণ বক্রি ৯৭৫ পিছ মাল ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ধ্বংসের কথা বলা হলো। কিন্তু বিচারিক আদালতের নথিতে ধ্বংসের প্রতিবেদন থাকে না। মাদক ধ্বংসে আদালতের অনুমতি থাকে না। যে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে মাল ধ্বংস করা হয়েছে, সেই ম্যাজিস্ট্রেটকে সাক্ষ্য মান্য করা হয় না কিংবা অপরাপর ব্যক্তিকেও সাক্ষ্য মান্য করা হয় না। আবার ধ্বংসের প্রতিবেদন দলিল হিসেবে জব্দ করা হয় না কিংবা ধ্বংস করা হয়েছে এমন কথা চার্জশীটের ৫ নম্বর কলামে উল্লেখ থাকার কথা থাকলেও সেটাও উল্লেখ করা হয় না। শুধু তাই নয়, মাল যে কোর্ট মালখানায় পাঠিয়েছেন তার প্রোপার্টি রেজিষ্টার নম্বরও উল্লেখ থাকে না। ফলে মালের উপস্থিতি কিংবা অবস্থান কিংবা ধ্বংসের সত্যতা নিয়ে রীতিরকম ধোঁয়াশা তৈরী হয়। মালের কারণেই অবশেষে মালের মালিক খালাস পায়।
অথচ আমাদের উচ্চ আদালত বলছেন, মামলার বিচার শেষে ফৌজদারী কার্যবিধির ধারা ৫১৭ এর আওতাধীন জব্দকৃত মালামাল নিষ্পত্তির জন্য উপযুক্ত আদালতে আবেদন করা যাবে। আর আপিলযোগ্য রায়ের ক্ষেত্রে সেগুলি ধ্বংসের জন্য রায়ের তারিখ থেকে আরো এক মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। আর যদি উক্ত মামলায় আপিল তাহলে আপিলের রায় পর্যন্ত মাল ধ্বংসের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। (৫৮ ডিএলআর ৬৫)। যদিও ২০১৮ সালের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে বিচারের পূর্বেই মাল ধ্বংস করা যাবে। কিন্তু অন্য আলামত যদি বিচারের আগেই ধ্বংস বা নষ্ট হয়, তাহলে তার আইনী সমাধান কি হবে।
ফলে আইন লঙ্ঘন করে আমরা প্রতিনিয়ত মাল ধ্বংসের উৎসবে মেতে উঠে মালের মালিককে খালাসের সুযোগ করে দিচ্ছি। প্রশ্ন উঠছে যে, এতো মাল রাখার কোর্ট মালখানায় জায়গা নেই। জায়গা নেই ভাল কথা; কিন্তু জায়গার ব্যবস্থা করুন। না করতে পারলে অন্তত আইনটা পরিবর্তন করুন। নতুবা বরাবরের মতোই মালখানার সোনা হয়ে যাবে তামা। আর মালের গলায় সুতা ঝুলিয়ে আদালতে উপস্থাপন করে সাক্ষ্য আইনের ৬০ ধারায় প্রয়োজনীয় উপাদান সম্পূর্ণ করার ব্যর্থ চেষ্টা চালিয়ে যাওয়ায় মালের মালিক খালাস পেয়ে যাক।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইনের শিক্ষক। ই-মেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com, , মোবাইলঃ ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
এ সম্পর্কিত বিষয়ে বিস্তারিত জানতে নিম্নের ভিডিওতে ক্লিক করুন