শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৪৩ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
বাঙালী জাতিকে ব্রিটিশ খুব সহজেই পরাজিত করে লর্ড ক্লাইভ তার ব্যক্তিগত ডায়েরীতে লিখেছিলেন, বাঙালীরা অধিকাংশই অত্যন্ত অলস, অজ্ঞ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন; হীনচেতা ও অকৃতজ্ঞ এবং অনেক সময়েই প্রতিহিংসা-পরায়ণ,স্বার্থপর, মিথ্যাচারী ও নির্লজ্জ। শিশুকাল থেকেই শেখানো হয় যে, বিষয়-সম্পত্তি সঞ্চয় করাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তাছাড়া, শঠতা, প্রবঞ্চনা প্রভৃতি পরিবেশের মধ্যে এরা বড় হয়ে ওঠে। জালিয়াতি ও ফাঁকিবাজিকে এরা খুব বাহবার কাজ বলে মনে করে। যে ক্ষেত্রে লালসা বা প্রতিহিংসা-প্রবৃত্তি অবাধে চরিতার্থ করা যায়, সেখানে এই হীন আচরণে এদের ক্লান্তিবোধ নেই। এটা বলছি দুশ বছর আগের কথা। এরপর দু’শ’ বছরে বাঙালীর চরিত্র অবশ্যই পাল্টেছে।
আজ আমরা যখন দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি ও প্রশাসনের অধীশ্বর ব্যক্তিদের দিকে তাকাই। দেশের বিবেক বলে পরিচিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণী, বিচারক, আইনজ্ঞ, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, শিক্ষকমন্ডলী এবং ধর্মব্যবসায়ীকে দেখতে পাই চাটুকার ও মোসাহেবদের ভিড়ে। তবে ব্যতিক্রম তো আছেই! আরো এক ধরনের বিসদৃশ প্রতিযোগিতাও দেখা যায়- কে কাকে ডিঙিয়ে যেতে পারে। এর বাইরেও যদি কেউ ভিন্নমত পোষণ করেন, যুক্তিসহ লিখিত আকারে জানাতে পারেন। তাহলে এতোদিন পরেও বাঙালী চরিত্রের আত্মসমীক্ষা ও আত্মবিশ্লেষণের অপরিহার্যতা লক্ষ্য করতে পারব।
লর্ড ক্লাইভ আরেক এক বিবরণীতে লিখেছিলেন,’ বাঙালীরা ভীরু ও দাসসুলভ। নিজেরা কিন্তু অধস্তনের কাছে উদ্ধত। অথচ উপরওয়ালার কাছে এরা সাধারণত বাধ্য থাকে। তবে যেখানে শাস্তির ভয় নেই সেখানে মনিবের কাছেও দুর্বিনীত হয়ে উঠতে পারে। ব্যক্তি হিসেবে এদের মানসম্মানবোধ খুব কম। জাতি হিসেবে এদের জনকল্যাণমূলক মনোভাব একেবারে নেই। যেখানে মিথ্যা কথা বললে কিছু সুবিধা হতে পারে সেখানে মিথ্যা কথা বলতে এদের একটুও বাধে না। এরা মনে করে চালাকি ও কূটকৌশল জ্ঞানের পরিচায়ক। লোকঠকানো ও ফাঁকি দেয়া জ্ঞানী লোকের গুন। অর্থ লালসা এদের প্রেরণার উৎস। এরা যে ডাহা মিথ্যা কথা বলতে পারে, চাকরের মতো তোষামোদ করতে পারে, ইচ্ছাকৃতভাবে ফাঁকি দিতে পারে এবং তা করেও থাকে সে-কথা বিশ্বাস করতে হলে এদের মধ্যে বেশ কিছু কাল কাটাতে হবে। আমরা অযথা এদের মধ্যে সংস্কারমুক্ত মন, গভীর চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী মানুষ খুঁজে মরি। তাদের রাষ্ট্র শাসনের জ্ঞান ঐ পর্যন্তই। এর ব্যতিক্রম অতি বিরল। তাদের মধ্যে সততা, সত্যবাদিতা ও বিশ্বস্ততার বড়ই অভাব।
যে ভৃত্য বাড়িতে দীর্ঘকাল কাজ করে মালিকের সঙ্গে তার যথার্থই একটা আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। কিন্তু তাই বলে মালিকের টাকা পয়সা চুরি করার অভ্যাস সে ছাড়ে না। পিতৃব্য যদি তার ভ্রাতুষ্পুত্রের ওপর, এমন কি পিতা যদি পুত্রের ওপর তার বিষয় দেখাশোনার ভার দেন তবে সে যে তার থেকে সরিয়ে নিজস্ব বিষয় গড়ে তুলবে না একথা নিশ্চয় করে বলা যায় না। কেউ শিশু সন্তান রেখে মারা গেলে তার বন্ধু-বান্ধব অছি হিসাবে নাবালকের বিষয়-সম্পত্তি রক্ষা করবে এটা একটা পবিত্র দায়িত্ব। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার অপব্যবহার ঘটে থাকে। তবে যে ব্যাপারে বাঙালীদের পারষ্পরিক আস্থা অটুট থাকে তা হলো অবৈধকর্ম। এক্ষেত্রে তারা কথার মর্যাদা রক্ষা করে চলে।
যখনই বিচারের ভার নেটিভদের ওপর অর্পণ করা হয়েছে, তা সে হিন্দুই হোক আর মুসলমানই হোক টাকা দিয়ে নরহত্যার অপরাধ থেকেও মুক্তি লাভ করেছে। টাকার এমনই শক্তি যে হলফনামা পাঠ করে মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া অতি সাধারণ অপরাধ। দু’পক্ষের সাক্ষী সত্য কথা বলার শপথ নিয়ে পরষ্পরের ঠিক বিপরীত কথা বলে যাচ্ছে- এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটে। একটু তদন্ত করলেই দেখা যাবে যে উভয়পক্ষের সাক্ষীরই প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে যথার্থ জ্ঞান নেই। আদালত থেকে এই সব দুর্নীতির উদ্ভব ঘটেনি, এর উৎস সাধারনের চরিত্রে।
সরাসরি লড়াই করে ক্ষোভ মেটানোর মতো যথেষ্ট মনোবল বাঙালীর নেই। তৎসত্ত্বেও চুরি, সিঁদকাটা, ডাকাতি, নদীবক্ষে ডাকাতি বস্তুত আঁধারে, গোপনে ও আকস্মিকতার সুযোগে যে সব অপকর্ম করা যায় সে সবই অত্যন্ত ব্যাপক। অতীতেও সর্বযুগে এটা ঘটেছে। চোর ও ডাকাতদের স্বতন্ত্র জাতি গড়ে উঠেছে। এদের বিশ্বাস এরা নিজ-নিজ বৃত্তি অনুসরণ করে চলেছে মাত্র। এরা সন্তানদেরও এই বৃত্তি শিক্ষা দেয়। পৃথিবীর কোথাও দুর্বৃত্তরা এতোটা নির্মম ও ধূর্ত হয় না। জেলার জমিদারেরা এদের পোষণ করে বা আশ্রয় দেয় এবং ডাকাতির ভাগ নেয়–একথা সকলেই জানে। এরা দলবেঁধে ডাকাতি এবং প্রায়ই মানুষ খুন করে। ডাকাতদের বাঁধা দল ছাড়াও পৃথক-পৃথক ডাকাতও আছে। এরা প্রতিবেশীদের ধনসম্পদ লুঠ করে। শুধু যে বড়ো বড়ো শহরে, ঘনবসতি অঞ্চলে বা তার আশেপাশে ডাকাতি হয় তা নয়, দেশের কোন অঞ্চল, এমনকি কোন গ্রামও তাদের হাত থেকে নিরাপদ নয়। প্রত্যেক অঞ্চল, রাজপথ ও নদীপথ থেকে ডাকাতি রাহাজানির অভিযোগ প্রায়ই পাওয়া যায়। এই সব অপরাধের দ্রুত বিচারের ব্যবস্থা আছে এবং বহু অপরাধীকে দণ্ড দানও করা হয়। তবু অপরাধ ঘটেই চলেছে। নবাবী আমলে বাংলায় বহুকাল ধরে ফৌজদারী বিচারে যে দুর্নীতি চলে আসছে তার ফলে এই উৎপাত বেড়ে গিয়েছে। বাঙালীদের শরীরের গঠন দেখে নরম মানুষ মনে হলেও এদের মনে প্রকৃত কোমলতা খুব কম। কয়েকটি বিষয় থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। প্রথমত শাস্তিদানের ব্যাপারে এরা ভয়ঙ্কর রকমের বর্বর। এরা অনায়াসে হাত,পা, কান বা নাক কেটে দিতে পারে অথবা চোখ উপড়ে নিতে পারে। তাছাড়া আরো নানা বিকট রকমে মানুষকে কষ্ট দিতে পারে।পরাজিত শত্রুর প্রতি এদের আচরণেও এই ক্রুরতার পরিচয় পাওয়া যায়। এরা অন্যের কথা ভাবে না। এটাই এদের চরিত্রের একটা প্রধান বৈশিষ্ট্য।
পাঠক! এ নিবন্ধটি পড়ার সময় বাঙালী হিসেবে আপনার দুঃবোধকে উস্কে দেয়, তাহলে ক্ষমা করে দেবেন। আপনি নিশ্চয়ই মীরজাফর, উমিচাঁদ, রায়বল্লভ ও ঘসেটি বেগমের নাম শুনেছেন। মাত্র সামান্য কয়েকটি টাকার জন্যই প্রায় ২০০ বছরের পরধীনতা মেনে নিয়েছিল। কিন্তু তাদের মৃত্যু হয়েছিল নির্মমভাবে। লর্ড ক্লাইভ লিখেছিলেন, নবাবকে যখন অপমান করতে করতে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন যত বাঙালী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসি তামাসা দেখেছিল, তারা যদি একটি করে ঢিল ছুড়তো, তাহলে আমরা মারা যেতাম। বাঙালী জাতির মানসিকতা সবচেয়ে নিখুঁতভাবে উপলব্ধি করা মানুষটির নাম লর্ড ক্লাইভ।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইনের শিক্ষক। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com