রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৫:২০ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 

এম. পি আনার’কে নিয়ে যত আইনী জটিলতা!

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
পাঠক, আপনারা ইতোমধ্যে শুনেছেন, জেনেছেন বাংলাদেশের একজন এমপি কলকাতায় গিয়ে নিখোঁজ হয়েছেন। কেউ বলছে খুন হয়েছেন, লাশ টুকরো টুকরো করে ট্রলিতে ভরে খালে ফেলে দেয়া হয়েছে। লাশ খুঁজতে কিংবা টুকরা মাংসের কিঞ্চিত পরিমাণ হদিস পেতে দুই দেশে পুলিশ, ডিবি, গোয়েন্দা সহ সহ বিভিন্ন ধরণের ইন্টিলেঞ্জ ব্রাঞ্চ কাজ করতে করতে হাঁফিয়ে উঠেছেন। মাস পেরিয়ে গেছে কিন্তু কোন নির্ভরযোগ্য সূত্রে তার নিখোঁজ কিংবা বেঁচে থাকার সংবাদ কিংবা কোন ক্রাইম সিন উদ্ধার করতে সক্ষম হয়নি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশে প্রথম তিনজন গ্রেফতার পরবর্তীতে আরও দুজন রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতার, রিমান্ড, দোষস্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি এবং কলকাতা ও নেপালে কসাই জিহাদ, সিয়াম’কে গ্রেফতার করে চলছে নানা অভিযান। এখন পর্যন্ত কোনো কুল কিনারা উদ্ধার হয়নি। অতীতেও এরকম রহস্যজনক খুন বা নিখোঁজের কোন তথ্য উপাত্ত উদঘাটন না হওয়ার অনেক ইতিহাস রয়েছে।

আইনী প্রশ্ন হচ্ছে যদি তার লাশ না পাওয়া যায়? কিংবা টুকরো মাংসের সাথে ডিএনএ ফরেনসিক রিপোর্ট না মেলে, তাহলে কী হবে? এমপি আনারের আসন শূন্য ঘোষণা হবে কী-না? সেখানে নির্বাচন হতে আইন সমর্থন করে কী-না? তার রেখে যাওয়া স্বর্ন চোরাচালানের শত শত কোটি টাকা ও সহায় সম্পত্তি তার ওয়ারেশগণ স্ত্রী কন্যা ভোগ দখল করতে পারবেন কী-না? এসব বিষয়ে প্রচলিত আইন, বাস্তবতা, অতীত দৃষ্টান্ত, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত কী বলছে তা নিয়েই আজকের নিবন্ধ।

শুরুতেই আসি সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনারের পদ শূন্য ঘোষণা নিয়ে কী জটিলতা তৈরি হয়েছে। কারণ এমপিকে হত্যার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে নিশ্চিত হওয়ার পর ওই আসনটি শূন্য ঘোষণা করবে সংসদ সচিবালয়। কারণ মৃত্যু, পদত্যাগ বা অন্য কোন কারণে সংসদের কোন আসন শূন্য হলে সংসদ সচিবালয় থেকে গেজেট প্রকাশ করে ওই আসনটি মৃত্যুর তারিখ থেকে শূণ্য ঘোষণা করা হয়। পরে গেজেটের কপি পাঠানো হয় নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে। নির্বাচন কমিশন ওই আসনে ৯০ দিনের মধ্যে উপ-নির্বাচনের আয়োজন করে। কিন্তু তাকে কবে হত্যা করা হয়েছে, কবে থেকে আসনটি শূন্য ঘোষনা করা হবে তা নিয়ে রয়েছে আইনী জটিলতা। সংসদ কার্যপ্রণালী বিধিতেও এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা নেই।

মরদেহ পাওয়া গেছে এবং জানাজা হয়েছে। সেই হিসাবে তাদের আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। এখানে সমস্যা হচ্ছে তার দেহ পাওয়া যায়নি। কিছু একটা পাওয়া গেলে সেটাও ডিএনএ ও অন্যান্য প্রমাণ সাপেক্ষে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বা গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের ওপর নির্ভর করে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।

পাঠক, আপনারা জানেন বাংলাদেশে ‘গুম’ বা নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা কম নয়। লাপাত্তা, নিখোঁজ, Missing, Empty, Disappear অনুপস্থিত প্রভৃতি শব্দ নিয়ে আইনের নানাবিধ ব্যাখ্যা আছে। দীর্ঘদিন যদি কোনো ব্যক্তির খোঁজ না মেলে, অর্থাৎ ওই ব্যক্তি মৃত নাকি জীবিত এমন ক্ষেত্রে নিখোঁজ ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করার সুনির্দিষ্ট কোনো আইন আমাদের দেশে নেই। নিখোঁজ ব্যক্তির সম্পদের কেউ উত্তরাধিকার দাবি করলে তাকে সাক্ষ্য আইনের ১০৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রমাণ করতে হবে যে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সাত বছরের বেশি সময় ধরে নিখোঁজ আছে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে সে ক্ষেত্রে আদালতের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
আইন বলছে, কোনো ব্যক্তির নিখোঁজের সময়সীমা সাত বছর অতিবাহিত হলেই কেবল সাক্ষ্য আইনের ১০৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী ধরে নিতে হবে তিনি মৃত। সে ক্ষেত্রে তার উত্তরাধিকারীরা সম্পদের অধিকারী হতে পারবে। তবে এ ক্ষেত্রে উত্তরাধিকারীদের কিছু আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে। অন্যথায় উত্তরাধিকারীদের সম্পদ হস্তান্তরে আইনি জটিলতায় পড়তে হতে পারে। যখন কোনো ব্যক্তি জীবিত আছে, না মারা গেছে এ বিষয়ে কোনো প্রশ্ন আসে সেক্ষেত্রে প্রমাণের দায়ভার (Burden of Proof) কার তা সাক্ষ্য আইনের ১০৭ ও ১০৮ ধারায় উল্লেখ আছে। ১০৭ ধারা বলছে, কোনো ব্যক্তি জীবিত না মৃত এবং তা দেখার জন্য বিগত ত্রিশ বছরের মধ্যে সেই ব্যক্তি জীবিত ছিল কি-না? তখন যে ব্যক্তি তাকে মৃত মর্মে দাবী করে, তা প্রমাণের দায়িত্ব সে ব্যক্তির উপর ন্যাস্ত থাকে। ১০৮ ধারা বলছে, ৭ বছর ধরে কোনো ব্যক্তির হদিস পাওয়া না যায় এবং যদি উনি বেঁচে থাকতেন সেক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবে যাদের সাথে উক্ত ৭ বছরে যোগাযোগ হত তাদের সাথে যদি কোনো যোগাযোগ না হয়, সেক্ষেত্রে যে ব্যক্তি তাকে জীবিত বলে দাবী করে তার উপর প্রমাণের দায়ভার বর্তায়।

জীবন ও মৃত্যুর অনুমান সম্পর্কে মুসলিম আইন বলছে, কোন লোক ‘লাপাত্তা’ হলে তার জন্ম তারিখ হতে গননা শুরু করে ৯৯ বৎসর-যাবৎ সে জীবিত ছিল বলে ধরা হয়। হিন্দু আইনের বিধান মতে কোন লোককে মৃত বলে ধরতে হলে তার নিখোঁজ হওয়ার তারিখ হতে ১২ বৎসর সময় অতিবাহিত হতে হবে। মুসলিম আইনে কোনো লোক সম্পর্কে ৯৯ বৎসর যাবৎ কোনো খোঁজ খবর পাওয়া না গেলে তাকে মৃত অনুমান করা হয়। সে মোতাবেক উত্তরাধিকার সূত্রে তার প্রাপ্ত সম্পত্তির মালিকানা বন্টিত হয়। কিন্তু প্রচলিত সাক্ষ্য আইন মুসলিম ও হিন্দু আইনের এরকম অভিমত অনুমোদন করে না।

কোনো ব্যক্তি নিখোঁজ হলে সাধারণ নিয়ম হলো তার উত্তরাধিকারীদের থানায় জিডি করতে হবে। মহামান্য হাইকোর্টের একটি রায় দৃষ্টান্ত উপস্থাপনের মধ্যে দিয়েই আজকের নিবন্ধ ইতি টানতে চলেছি। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদ মার্কেটের একটি দোকান বরাদ্দ নিয়েছিলেন মোঃ ইসমাইল নামের এক ব্যক্তি। ‘ক্যালকাটা গান (বন্দুক) রিপেয়ারিং ওয়ার্কস’ নামের ওই দোকানে বন্দুক মেরামত করা হতো। ইসমাইল হোসেন দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পর তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে দোকানের মালিকানা দাবি করে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের আবেদন করেন খায়রুন নেসা। তিনি আবেদনে নিজেকে ইসমাইলের ভাগ্নি এবং একমাত্র উত্তরাধিকারী দাবি করেন। কিন্তু ইসলামিক ফাউন্ডেশন তাঁকে ওই দোকানের মালিকানা দিতে রাজি না হওয়ায় তিনি ১৯৮৮ সালে ঢাকার নিম্ন আদালতে মামলা করেন। ওই আদালত তাঁর আবেদন খারিজ করে দেন। এরপর তিনি ওই রায়ের বিরুদ্ধে ১৯৯৫ সালে হাইকোর্টে আপিল (প্রথম আপীল ৩৬৬/৯৫) করেন। এই মামলায় শুনানি শেষে হাইকোর্ট ১৯৯৭ সালের ২০ মে রায় দেন। ওই রায় খায়রুন নেসার পক্ষে যায়। ওই রায় অনুযায়ী দোকানের মালিকানা পান তিনি। সাক্ষ্য আইনের ১০৮ নম্বর ধারা বিবেচনায় নিয়ে হাইকোর্ট রায় দেন। কাজেই নিখোঁজ বা লাপাত্তা ব্যক্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে সহায় সম্পত্তি পেতে উত্তরাধিকারীকে ঘোষণামূলক মোকদ্দমা দায়ের করে সমাধান নিতে হবে। এক্ষেত্রে এমপি আনারের শত শত কোটি টাকার সহায় সম্পত্তি তার উত্তরাধিকারীদের পেতে কী বেগ পেতে হবে আর ওই আসন শূণ্য করে নির্বাচন হতে কী আইনী জটিলতা রয়েছে পাঠক নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে পারছেন। তবে এ সমস্যা সমাধানে উচ্চ আদালত এগিয়ে আসতে পারেন।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel