রবিবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:০৫ অপরাহ্ন
ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় বিজয়ঃ প্রত্যাশার পারদ আকাশ ছুঁয়েছে
মোঃ আক্তারুজ্জামান
নজিরবিহীন ঘটনার মাধ্যমে বাংলাদেশের একটি দুঃস্বপ্নের অধ্যায়ের কাঙ্ক্ষিত সমাপ্তি ঘটেছে। দেশটির ইতিহাসে এটাই প্রথম ঘটনা যার নির্বাহী প্রধানকে পালিয়ে দেশ ছাড়তে হয়েছে। আর এটাই হয়তো অনিবার্য ছিল- গত দেড় দশক ধরে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিটি স্তরে অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, লুটতরাজ এবং দুঃশাসন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে দেশে আইনের শাসনের লেশমাত্র নেই। এক ব্যক্তির স্বেচ্ছাচারী শাসনের একটি জ্বলজ্বলে দৃষ্টান্তে পরিণত হয়েছিল দেশটি। রাজনৈতিক স্বাধীনতার প্রশ্ন তো কল্পনাতীত, মৌলিক মানবাধিকার, বাক স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা নামক বিষয়গুলো জনগণের কাছে অপরিচিত বিষয়ে পরিণত হচ্ছিল। রাষ্ট্রযন্ত্রের যথেচ্ছা প্রয়োগের মাধ্যমে হত্যা, ধর্ষণ, গুম, মানি লন্ডারিং ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা। দেশের প্রকৃত মালিকগণ নিজের দেশেই হয়ে উঠেছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। এই অবস্থাটি যখন চরমে উঠে যায়, তখন তখন দৃশ্যপটে আসেন দেশটির নতুন প্রজন্ম। এই প্রজন্ম ঠিক অর্ধযুগ আগে একবার আত্মপ্রকাশ করে সমগ্র জাতির মনোজগতে নাড়া দিয়ে গিয়েছিল। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন নামে সেই আন্দোলনের মাধ্যমে হয়তো তারা সেদিন জানান দিয়েছিল তারা পরিণত হয়ে আসছে রাষ্ট্র সংস্কার করতে। কন্তু ততদিনে দেশটিকে সাক্ষী হতে হয়েছে অনেক রক্ত, অনেক ক্ষয় আর মূল্য। গত দেড় দশক ধরে স্বৈরাচারী শাসকের রক্ততৃষ্ণার বলি হতে হয়েছে অগণিত তাজা প্রাণের। যেখানে সূধী সমাজের কাছে একটি অস্বাভাবিক মৃত্যুও কাম্য নয় সেখানে জাতি তার সূর্য সন্তানদের হারিয়েছে হাজারে হাজারে। যে তরুন সমাজকে উপলক্ষ করে জাতি তার স্বপ্ন বোনে, সেই তরুন মেধাবী শিক্ষার্থীদের উন্মুক্ত বক্ষে এই রাষ্ট্র গেঁথে দিয়েছ ঘাতক বুলেট। তবুও তরুনদের রাষ্ট্র মেরামতের সেই সংকল্প থেকে ক্ষমতালিপ্সু শাসকের পক্ষে একবিন্দু টলানো সম্ভব হয়নি। প্রতিটি বুলেটের জবাবে তরুণরা দ্বিগুন শক্তি হয়ে একনায়কের ভীত কাঁপিয়ে দিয়েছে। সমগ্র বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে তারা সমস্ত অপশক্তিকে পরাজিত করে আরো একবার বাংলাদেশকে স্বাধীনতার স্বাদ দিয়েছে। তারুণ্যের সেই জয়যাত্রায় অনুপ্রেরণা হিসেবে সাথে ছিল এদেশের আপামর জনতা। লাল-সবুজের পতাকাটির পুনর্জন্ম হয়েছে পাঁচই আগস্ট দুই হজার চব্বিশ তারিখে, তরুন সমাজ যাকে ডেকেছে ৩৬ শে জুলাই নামে! পাক-হানাদারের কবল থেকে মুক্তির ৫৩ বছরে ধীরে ধীরে যে অপূর্ণতা, অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা আর হতাশার মহাসমুদ্র তৈরী হয়েছে, এই বিজয়ের উপর দায় পড়েছে সেই মহাসমুদ্রের উপর চর জাগিয়ে টেকসই আবাস স্থাপন করা। দুঃসাধ্য হলেও অসম্ভব নয়, যদি তারুণ্যের শক্তি এই যাত্রার জাগ্রত প্রহরীর দায়িত্ব পালন করার সুযোগ পায়। দুর্গম গিরি, কান্তার মরু, দুস্তর এই পারাবারের জন্য আমাদের জোয়ানদের তাৎক্ষণিক ও দীর্ঘমেয়াদে মোকাবেলা করতে হবে অসংখ্য চ্যালেঞ্জ।
বিজয়ের পর তাৎক্ষণিক চ্যালেঞ্জ হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সম্পদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলা, গ্রাম্য রাজনীতির সহিংস চর্চা, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের নেতাকর্মী ও তাদের সম্পদের উপর হিংসাত্মক হামলা, স্বার্থান্বেষী মহলের ছদ্মবেশে লুটপাট অন্যতম। সাবেক প্রধামন্ত্রীর পালানোর পরই সেই পরিস্থিতি শুরু হয়ে গেছে। তিনি পালিয়ে গিয়ে সমগ্র দেশ, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ এবং তার নেতকর্মীদের চরম ঝুঁকির মধ্যে ফেলে গেছেন। দেশব্যাপী এই চরম বিশৃঙ্খলার যে সূত্রপাত তিনি করে গেলেন, স্বার্থান্বেষী ও প্রতিক্রিয়াশীলদের জন্য যে সুযোগ তিনি সৃষ্টি করে দিলেন তা দেশকে আরো সংকটে ফেলবে। আগাম ঘোষণা দিয়ে পদত্যাগ করে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে তিনি নিজের সম্মান যেমন ধরে রাখতে পারতেন, তেমনি তার দল, দলের নেতাকর্মী এবং দেশকে এই গভীর সংকটে পড়তে হতো না। প্রশাসন আগে থেকে প্রস্তুতি নিতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকতে পারতো। পালিয়ে গিয়ে তিনি নিজে বাঁচলেন ঠিকই, পুরো দেশকে দুষ্কৃতকারীদের হাতে তুলে দিয়ে জাতিকে অনিশ্চয়তায় ফেলে গেলেন। আজ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ঘর-বাড়ী, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, গণভবন, সংসদ ভবন সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাষ্ট্রবিরোধী চক্র যেভাবে আক্রমণ করেছে তা কোনভাবেই ছাত্রদের আক্রমণ হতে পারে না। প্রাপ্ত বিভিন্ন ফুটেজে সেই তথ্যই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই চরম সংকটময় মুহূর্তে আবার ছাত্রসমাজকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে একযোগে কাজ করতে হবে। চলমান সংকটের প্রত্যেকটি অপকর্মের সাথে জড়িত দুষ্কৃতকারীদের কঠিন ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে যা দেখে ভবিষ্যতে কেউ দেশ ও জনস্বার্থের পরিপন্থী কোন কাজ এবং নাশকতা করতে সাহস না পায়। মনে রাখতে হবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন দেশের জন্য জীবন দিয়েছেন বাংলার হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ খ্রিস্টান এক হয়ে, আজকের নতুন স্বাধীনতার জন্যেও জাতি, ধর্ম, বর্ণ এক হয়েছিল। তাহলে আজ যখন জাতির একটি অংশ আনন্দ আয়োজনে ব্যস্ত, তখন অন্য একটি অংশ শোকের প্রস্তুতি কেন নিবে? অথচ সবাই এক হয়ে বিজয়োল্লাস করার কথা ছিল। দুস্কৃতকারী এবং নাশকতার সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সাথে সাথে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে আজ থেকেই। নতুন দিনের শুরু থেকেই মূল্যবোধের চাষ করা শুরু হোক।
স্বাধীনতা বড্ড দুষ্প্রাপ্য ও স্পর্শকাতর বিষয়- অনেক ত্যাগ, অনেক রক্ত, অনেক সাধনা দিয়ে কিনতে হয়, আবার রাখতে হয় অত্যন্ত যত্নে। একটু সচেতনতা, যত্ন, পরিচর্যার অভাব হলেই সে অভিমান নিয়ে হারাতে থাকে। আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চত করার জন্য সমগ্র রাষ্ট্র কাঠামো এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তন নিয়ে আসার কোন বিকল্প নেই। নতুনভাবে গণপরিষদ গঠন করে রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও সংবিধানে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। মনে রাখতে হবে বিদ্যমান সংবিধানকে আঁকড়ে ধরেই বিগত দিনে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নতুন সংবিধান গড়তে হবে উন্নত দেশগুলোর সংবিধানের তুলনামূলক অধ্যয়নের মাধ্যমে যা দিয়ে স্বৈরাচার সৃষ্টি হওয়ার সকল চেষ্টা নস্যাৎ করা সম্ভব হাবে। দেশের সকল স্তরের নাগরিকের রাজনৈতিক অংশগ্রহণ নিশ্চত করতে না পারলে রক্তের নদী পেরিয়ে যে স্বধীনতা অর্জিত হয়েছে তা আবার হারিয়ে যাবে।
মুখে বললেও আমরা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হতে পারিনি, বিভিন্ন রাষ্ট্রের আঙ্গুলের নির্দেশে আমাদের রীতি-পদ্ধতিকে রচনা, পরিবর্তন, পরিবর্ধন বা বাতিল করতে হয়। সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে যে বিপুল পরিমাণে বিদেশী আমাদের শ্রমবাজারে নিয়োজিত থেকে অবৈধভাবে মুদ্রা পাচার করে রিজার্ভ ফাঁকা করে দিচ্ছে, অথচ আমার দেশের এই সম্ভাবনময় তারুণ্য বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে তিলে তিলে ধ্বংস হচ্ছে।
আমলাতন্ত্র আজ জনগণের সেবক না হয়ে প্রভূতে পরিণত হয়েছে। আমলাতন্ত্রের যুগোপযোগী সংস্কার ছাড়া এই ঔপনিবেশিক আমলাতন্ত্রিক ব্যবস্থার মাধ্যমে রাষ্ট্র কঠামোর গুণগত সংস্কার সম্ভব নয়, কারণ বিদ্যমান আমলাতন্ত্র স্বৈরতন্ত্রকে লালন, পালন ও ধারণ করতেই অভ্যস্ত, জনসেবা নয়। এই সর্বভূক আমলাতন্ত্রকে পরিপূর্ণভাবে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রশাসনেও সমস্ত প্রকার কোটা বিলুপ্ত করে মেধাভিত্তিক কৃত্য পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে।
যে শিক্ষাঙ্গন থেকে এই দিন বদলের আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেই শিক্ষাঙ্গনকে জ্ঞান চর্চার জন্য উপযুক্ত করে গড়তে হবে। ক্যাম্পাসকে দলীয় লেজুড়বৃত্তির রাজনীতি থেকে বাইরে রেখে ছাত্র সংসদকে শক্তিশালী করতে হবে।
বিচারবিভাগীয় কাঠামো, শিক্ষা, চিকিৎসা সহ প্রতিটি সেক্টরকে সাজাতে হবে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণা ও তুলনামূলক অধ্যয়নের উপর ভিত্তি করে। সরকারি তহবিলের একটি পয়সারও জবাদিহিতা নিশ্চিত করার বাইরে রাখা যাবে না। দুর্নীতি ও দুর্নীবাজদের বিষয়ে সবচেয়ে কঠিন অবস্থান নিশ্চত করা এখন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। সুশাসনের প্রতিটি নির্দেশক ধরে ধরে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
দেশের সুশীল সমাজকে আর দূরে সরিয়ে রাখা যাবে না, প্রতিটি স্তরের সুশীল ও বুদ্ধিজীবীদের সরাসরি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের সুযোগ রাখা দরকার, সেজন্য যদি সংসদীয় কাঠামোতে পরিবর্তন আনতে হয়, তবে তাই করতে হবে।
রাষ্ট্র হোক প্রকৃত অর্থে কল্যাণরাষ্ট্র- যে রাষ্ট্রে প্রতিটি সত্তা দেশটির প্রতি ইঞ্চি মাটিকে নিজের সম্পদ মনে করবে। এই আবু সাঈদদের হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না যারা দেশের জন্য বুক পেতে দিতে পারে, এই মুগ্ধদের বিলিয়ে দেওয়া পানি ছড়িয়ে পড়ুক দেশের প্রতিটি প্রান্তে, গড়ে উঠুক তারুণ্যের শক্তিনির্ভর এক স্বনির্ভর বাংলাদেশ। আমাদের আজকের কোন ভুলের কারণে যদি এই তারুণেরা দেশকে নিজের ভাবতে না পারে, তবে আমরা আবার ব্যর্থ হবো, এই রক্ত আমাদের ধিক্কার দিবে।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, রাষ্ট্রিবিজ্ঞান বিভাগ
রামদিয়া সরকারি শ্রীকৃষ্ণ কলেজ, কাশিয়ানী, গোপালগঞ্জ
ই-মেইল: akhtar30bcs@gmail.com