শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ০৬:০৫ অপরাহ্ন
রক্তস্নাত বাংলায় আগামীর কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রত্যাশা।
এনতেজার ফেয়ার মুনতাহা
ছাত্র জনতার ত্যাগ, শ্রম, ঘাম, রক্ত, মাংস ও জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশের একটি দুঃস্বপ্নের অধ্যায়ের কাঙ্খিত সমাপ্তি ঘটেছে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো নির্বাহী প্রধান বলা যায় এক কাপড়ে দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছে। আর এটাই হয়তো ছিল তার উপযুক্ত প্রাপ্তি অথবা তার কৃতকর্ম বলে তার পরিণতি আরো ঘৃণ্য থেকে ভয়ংকর হওয়ার কথা ছিলো। গত দেড় দশক ধরে আওয়ামী সরকারের রাজনীতি বিরাজের মধ্য দিয়ে দেশের প্রতিটি স্তওে স্তরে ছিল অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, লুটতরাজ এবং দুঃশাসন। আর এই দুঃশাসনের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌছেঁছে যে দেশে আইনের শাসনের সামান্য পরিমাণও সঠিক ব্যবহার করা হয়নি। আর তখনই দেশে স্বৈরাচারী শাসকের দৃষ্টান্ত ফুটে ওঠে।
এই আওয়ামী সরকার জনগনের কাছ থেকে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা, মৌলিক অধিকার; বাক স্বাধীনতা, চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা হরণ করে নেয়। এমনকি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে জনগন তাদের ন্যায্য ভোটটুকু দিতে পারেনি। ছিলনা কোন মত প্রকাশের স্বাধীনতা, কেউ দুর্নীতি করবে কিন্তু তার প্রতিবাদ করলেই প্রতিবাদকারীর উপর নেমে আসত নির্মম অত্যাচার। তারই ভলি হতে হয়েছে আবরার ফাহাদকে। রাষ্ট্র অসাম্প্রদায়িক চেতনা ধারন করলেও মানুষকে ধর্মীয় স্বাধীনতা পর্যন্ত দেওয়া হয়নি।
আওয়ামী সরকারের নেতাকর্মীরা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে স্তরে সৃষ্টি করেছে বিশৃঙ্খলা। অন্যদিকে গুম, খুন, ধর্ষণ, মানিলন্ডারিং, হানাহানি, মারামারি ছিল খুবই সাধারণ ব্যপার। এই আওয়ামী শাসক সকল অন্যায়ের প্রতিকার না করে তিনি হয়ে ওঠেন শোষক। শাসক যখন শোষক হয় তখন দেশ কি আর নিরাপদ রয়?
এই স্বৈরাচারী শাসকের অন্যায়ের অবসান কোন রাজনৈতিক দল করতে পারেনি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে। অবশেষে ছাত্র-নাগরিক গণ অভ্যুথানের মধ্য দিয়ে গত ৫ই আগস্ট ২০২৪ তারিখে স্বৈরাচার হাসিনার শাসনের অবসান ঘটায়। ২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক নিয়ে শিক্ষার্থীরা রাজপথ কাঁপায়। ২০১৮-এ বাংলাদেশে কোটা সংস্কার আন্দোলন ছিল বাংলাদেশে সব ধরনের সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের প্রচলিত ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে সংগঠিত একটি আন্দোলন। ১৯৭২ সাল থেকে চালু হওয়া কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে চাকরি প্রত্যাশী ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতৃত্বে ২০১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ধারাবাহিকভাবে বিক্ষোভ এবং মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে। লাগাতার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে ৪৬ বছর ধরে চলা কোটাব্যবস্থা বাতিল ঘোষণা করে সরকার। পরবর্তীতে ২০২৪ সালের জুন মাসে বাংলাদেশ হাইকোর্ট বাতিলকৃত কোটা পুনরায় বহাল করে। যার ফলে পুনরায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। চাকরিতে ৫৬% কোটা (মুক্তিযোদ্ধা-৩০%, নারী-১০%, জেলা-১০%, উপজাতি-৫% এবং ১% প্রতিবন্ধী কোটা) ছিল। কোটার পাশাপাশি দুর্নীতি তো আছেই, তার মধ্যে অন্যতম প্রশ্ন ফাঁসের মত দন্ডনীয় অপরাধ এবং লীগ কোটা ও সুপারিশ কোটা তো থাকছেই। এই কোটা ও দুর্নীতির কারনে মেধাবী শিক্ষার্থীরা বরাবরই হচ্ছে বঞ্চিত। এর ফলে দেশে উপযুক্ত শিক্ষার ব্যবহার না হওয়া এবং বেকারত্ব বেড়েই চলছিল।
শিক্ষার্থীরা এই কোটার সুষ্ঠ সংস্কার দাবি করে, যেখানে থাকবে ৫% কোটা কিন্তু সরকার তা মেনে না নিয়ে শিক্ষার্থীদের ওপর তার দলীয় ছাত্রলীগ নেতা কর্মীদের দ্বারা নির্যাতন চালায়। এই কর্মকান্ডের পর শিক্ষার্থীরা আরো বেশি অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের আন্দোলন চালিয়ে গেলে প্রশাসন দ্বারা শিক্ষার্থীদের রক্ষার বদলে তারা হামলা চালায়। শিক্ষার্থীদেও বুকে রাবার বুলেট ছুুড়ে, এমনকি তারা শিক্ষার্থীদেও মাথায় শুট পর্যন্ত করে। এই আন্দোলনে প্রথম পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আবু সাঈদ। পরবর্তীতে শহীদ হন মুগ্ধ, ওয়াসিম, আসিফ, ফাইয়াজ, কয়েকজন শিশু সহ আরো অনেকে। এই আন্দোলনে অনেক শিক্ষক শিক্ষার্থীদের পাশে দাড়ায় এবং তাদের সহোযোগিতায় এগিয়ে আসে। সরকার শিক্ষার্থীদের দমাতে না পারলে। তারা শিক্ষার্থীদের এরেস্ট করা শুরু করে। তার পাশাপাশি গুম করে নিয়ে অমানবিক নির্যাতন চালায়। তখনো কিন্তু হত্যাকান্ড থেমে থাকেনি। তারা উঠিয়ে নেয় আন্দোলনের ছয় সম্বন্বয়কদের। পরে তাদের অনশনের কারনে তাদের ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। কোটা আন্দোলন থেকে তা স্বৈরাচারী সরকার পতন আন্দোলনে রূপ নেয়। পরবর্তীতে ৫ আগস্ট (৩৬শে জুলাই) সরকারের পদত্যাগের জন্য লং মার্চ টু ঢাকার কর্মসূচি দেন সম্বন্বয়করা। যার প্রধান কাজ হচ্ছে গনঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে স্বৈরাচারী সরকার পতন। স্বৈরাচারী সরকার যখন দেখল তার আর রক্ষে নেই তখন এই জালিম শাসক পদত্যাগ করে পালিয়ে দেশ ছাড়ে। অবশেষে শিক্ষার্থীরাই হাজারো শহীদদের রক্তের বিনিময়ে এই অন্যায়ের অবসান ঘটায় এবং মানুষ তাদের দেশকে স্বাধীন করে পায়।
স্বৈরশাসকের পতন হলেও কিছু মানুষ প্রতিশোধ ও প্রতিহিংসার বশবর্র্তী হয়ে সংখ্যালগু ও অন্যান্যদের উপর হামলা চালায়। তবে শিক্ষার্থীরা তাদের নিরাপত্তার জন্য আপ্রান চেষ্টা করে। এই চরম সংকটময় মুহূর্তে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি ছাত্রসমাজকে কাজ করতে হবে। এই সকল কর্মকান্ডে জড়িত দুষ্কৃতকারীদের কঠিন এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে; যা দেখে ভবিষ্যতে দেশে কেউ জনস্বার্থ পরিপন্থী ও নাশকতামূলক কাজ করতে সাহস না পায়।
স্বাধীনতা অর্জন করতে হয় অনেক ত্যাগ, রক্ত ও সাধনা দিয়ে। আর এই স্বাধীনতাকে রাখতে হয় অনেক যত্নে। একটু সচেতনতা ও যত্নের অভাব হলেই তা হারিয়ে যেতে থাকে। কথায় আছে, স্বাধীনতা অর্জনের চেয়েও স্বাধীনতা রক্ষা করা কঠিন। তাই আমাদের এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য ও আগামীর আদর্শ বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য জাতি, ধর্ম, বর্ণ সকলকে এক সাথে কাজ করতে হবে।
আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য রাষ্ট্র কাঠামো ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গুণগত পরিবর্তনের কোন বিকল্প নাই। রাজনৈতিক কাঠামো ও সংবিধানকে এমন ভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন আবার স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে। আগামীর বাংলাদেশ হবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। যেখানে থাকবে না কোন ধর্ম,বর্ণ,জাতি ভেদাভেদ, না থাকবে কোনো প্রতিহিংসা বা বিদ্বেষ। সংবিধান গঠন করতে হবে এমনভাবে যেন কোনো ধর্মের বা এবং জনগনের নিরাপত্তার বেঘাত না ঘটে।
প্রশাসনেও সকল প্রকার কোটা বিলুপ্ত করে মেধাভিত্তিক কৃত পেশাভিত্তিক মন্ত্রণালয় গঠন করতে হবে। যে শিক্ষাঙ্গন থেকে এই দিন বদলের আন্দোলন শুরু হয়েছে, সেই শিক্ষাঙ্গনকে জ্ঞান চর্চার জন্য উপযুক্ত করে তুলতে হবে। সকল কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসকে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে দূরে রেখে ছাত্র সংসদকে শক্তিশালী করতে হবে।
বিচারবিভাগীয় কাঠামো, শিক্ষা, চিকিৎসা সহ সকল ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন আনতে হবে। পরিবর্তন আনতে হবে অর্থনৈতিক কাঠামোতে যেমন- অর্থ পাচার রোধ করা , দ্রব্য মূল্যের দাম কমানো, মূল্যস্ফীতি কমানো। তাছাড়া অর্থনীতিতে সকল দুর্নীতি বন্ধ করলেই দেশের সকল দারিদ্র্যতা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। রাষ্ট্রের রন্দ্রে রন্দ্রে জড়িয়ে থাকা সকল দুর্নীতি ও অন্যায় অবিচার রোধ করতে হবে। দেশকে গড়তে হবে সুশাসনের স্তবক ধরে।
রাষ্ট্র হবে এমন যেখানে স্তওে স্তরে শৃঙ্খলা, শান্তি ও ন্যায় বিচার বজায় থাকবে। তখনই বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রে। বাংলাদেশকে আমরা সঠিকভাবে গড়ে তুলতে পারলেই বিশ্বের মাঝে এক অনন্য দেশ হিসেবে ফুটে ওঠবে। বাংলাদেশ হবে একটি আদর্শ কল্যাণ রাষ্ট্র এমনটাই প্রত্যাশা।
লেখিকা,
এনতেজার ফেয়ার মুনতাহা
শিক্ষার্থী, ইসলামীয়া আলীয়া মাদ্রাসা, কুমিল্লা।