বৃহস্পতিবার, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০৯:৫৫ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
মারামারি মামলায় আসামীর বিরুদ্ধে শুরুতেই দন্ডবিধির বড় বড় ধারায় মামলা হয়। এমনকি দন্ডবিধির ৩২৬ ধারার মতো মারাত্মক আঘাতের ধারা সংযুক্ত করা হয়। যে আঘাতে একজন মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ৩২৬ ধারায় উল্লেখ রয়েছে, গুলি, ছুরি বা ধারালো যেকোনো অস্ত্র বা যন্ত্রের মাধ্যমে আঘাত, যা মৃত্যু ঘটাতে পারে। আগুন বা উত্তপ্ত পদার্থ, বিষ বা ক্ষয়কারক বা বিস্ফোরক বা এমন কোনো পদার্থের মাধ্যমে আঘাত, যা মানবদেহে কোনোভাবে প্রবেশ করে ক্ষতি করে। এই অপরাধে যাবজ্জীবন বা ১০ বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা হতে পারে।
আসামী পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার কিংবা সংশ্লিষ্ট আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন চাইলে বিচারক এ ধরণের বড় ধারা দেখে সহসাই জামিন দিতে চান না। অনেক উদাহরণ আছে যে, আসামী এ জাতীয় মামলায় দুই/তিন মাস হাজতবাসের যখন মেডিক্যাল সার্টিফিকেট আসে, তখন দেখা যায় ভিকটিমের শরীরের আঘাতটি ছিল সিম্পল ইনজুরি। সাধারণ মানের আঘাত। দন্ডবিধির ৩২৩ ধারা। আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জামিনযোগ্য এবং গ্রাম আদালত কর্তৃক বিচার্য। এক্ষেত্রে আসামীর হাজত খাটা আপাতদৃষ্টিতে দুঃখজনক এবং নির্দোষ ব্যক্তিদের অন্যায্য কারাবাসও বটে।
আবার তদন্ত পরবর্তী সময় প্রায়ই দেখা যায় যে, কোদাল, রামদা, হাসুয়া দিয়ে করা আঘাতটি হয়ে যায় রীতরকম ভোতা অস্ত্র (blunt weapon), আর গুরুতর আঘাত (grievous hurt) হয়ে যায় সাধারণ আঘাত (simple hurt)।
আমরা যারা আইন অঙ্গনে কাজ করি বিশেষ করে বিচারক, আইনজীবী, পুলিশ, চিকিৎসক কম-বেশি সকলেই এ ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন। এ জাতীয় ঘটনার মুক্তি ও সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে জখমীদের হাসপাতালের ছাড়পত্র (discharge certificate) এ চিকিৎসার ধরণ ও বর্ণনা। তাহলেই নির্দোষ ব্যক্তিদের অন্যায্য কারাবাস থেকে রেহাই দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সাধারণত রোগীকে যখন হাসপাতাল থেকে ছুটি দেওয়া হয় তখন তাকে একটি ছাড়পত্র (discharge certificate) দেওয়া হয়। চিকিৎসকগণ বাংলাদেশ ফরম নং-৮১৭ তে এটি লিখে থাকেন। এতে রোগীর নাম, বয়স, পিতা/স্বামী, ঠিকানা, হাসপাতালের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, ওয়ার্ড, বেড নং, চিকিৎসার সময়কাল এবং রোগের নাম সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ পূর্বক সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক তারিখসহ স্বাক্ষর প্রদান করার কথা। শুধু তাই নয়, রোগী কি সমস্যা নিয়ে এসেছিলেন, প্রাথমিকভাবে পরীক্ষা করে কি অবস্থা পাওয়া গেছে, কি কি টেস্ট করানো হয়েছে এবং সেগুলোর ফলাফল কি, অপারেশন হয়ে থাকলে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ, কি কি ওষুধ কত দিন যাবৎ সেবন করবেন এবং পরবর্তীতে কতদিন পর জখমের সেলাই কাটতে হবে বা হাসপাতালে আসতে হবে- এই বিষয়গুলিও লিপিবদ্ধ থাকার কথা। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, ছাড়পত্র প্রদানে এ নিয়মগুলো কেউ মানছেন না।
আবার মামলা দায়েরের পর আদালত বা তদন্তকারী সংস্থা মেডিক্যাল সার্টিফিকেট চাইলে শুরু হয় নানা জটিলতা। জখমীর জন্য বোর্ড গঠন ও পরীক্ষা নিরীক্ষা করা, এমসিসহ ফরোয়ার্ডিং প্রস্তুতকরণ এবং তা ডাকযোগে প্রেরণ ইত্যাদি নিয়মাবলী মেনে চলতে দীর্ঘ সময় কেটে যায়। অধিকাংশ মামলার এজাহার বা নালিশে সত্য-মিথ্যার সংমিশ্রণে যে অতিরঞ্জিত বক্তব্য থাকে তা শুরুতেই প্রাথমিকভাবে সত্যতা নিরূপণের জন্য ছাড়পত্রের বর্ণনা খুবই জরুরী। তবে বিভিন্ন হাসপাতালের ছাড়পত্রের লেখাগুলোতেও ভিন্নতা পাওয়া যায়।
আবার মারামারির মামলাগুলোর জখমীর ছাড়পত্রে কি রোগে ভূগছিলেন এর জায়গায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে physical assault লেখা থাকে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, পেটে ছুরি মারলেও যা লেখা হয়, মাথা ফাটলেও বা হাড়ভাঙ্গা জখম হলেও একই কথা লেখা থাকে। কিন্তু শরীরের কোথায় জখম হয়েছে, ক্ষতের পরিমাণ, অস্ত্রের প্রকৃতি ইত্যাদি বিষয় উল্লেখ থাকে না। যদি এগুলো ভালভাবে লেখা থাকে তাহলে শুধু ভালো মামলাগুলোই এজাহার হিসেবে রেকর্ড হবে এবং জামিন শুনানীকালেও সেগুলো বিজ্ঞ বিচারক ছাড়পত্রে বর্ণিত ইনজুরি নোট বিবেচনায় নিতে পারেন। ফলে যে আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছাড়পত্রে বর্ণিত ইনজুরি নোট দ্বারা সমর্থিত নয়, তিনি অন্যায্য কারাবাসের সম্মুখীন হবে না। তাছাড়া প্রকৃত জখমের সাথে মেডিকেল সার্টিফিকেটে বর্ণিত জখমের হেরফের পরিলক্ষিত হলে নারাজি শুনানির সময়ও বিজ্ঞ ম্যাজিস্ট্রেট তা বিবেচনায় নিতে পারেন। কিন্তু দুঃখের সাথে জানাতে হয়, রোগীর ছাড়পত্রে সবগুলো তথ্য সঠিকভাবে তুলে ধরা হয় না। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে।
পরিশেষে বলা যায়, আঘাতজনিত বা মারামারি মামলায় হাসপাতাল কর্তৃক ছাড়পত্র, মেডিক্যাল সার্টিফিকেট, বিনা দোষে আসামীর হাজতবাস, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের জটিলতা, ছাড়পত্রের অস্পষ্টতা, ইনজুরি নোটের গুরুত্ব, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সমস্যা ও করণীয় বিষয় নিয়ে এখনই ভাবার দরকার।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, গবেষক ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮
বিস্তারিত জানতে ভিডিওটি দেখুন: