শনিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩০ অপরাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাবে যা করণীয় জমি আপনার, দখল অন্যের! কী করবেন? রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে সংবিধান, আইনী নৈরাজ্য ও অতীত ইতিহাস! শেখ হাসিনার পদত্যাগপত্র নিয়ে রাষ্ট্রপতির মিথ্যাচার বনাম সাংবিধানিক সমাধান! সহায় সম্পত্তি পুণ্যের কাজে ওয়াক্ফ গঠন ও প্রাসঙ্গিকতা! শেকড়ের সন্ধানে সাঁইজির ধামেঃ লালন কি জাত সংসারে— রক্তাক্ত মাহমুদুর রহমানের কুষ্টিয়ায় আগমন বনাম দুধের মাছিদের আনাগোনা! জনপ্রশাসন, জেলা প্রশাসক ও স্যার সম্বোধন কতটা সংবিধান ও আইনসম্মত! ক্রেতা ঠকে গেলে বিক্রেতার বিরুদ্ধে যত আইনগত প্রতিকার! আইনে জামিন চর্চা বনাম বিচারকের পদত্যাগের দাবীতে আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ!
স্বাধীনতার ৫৩ বছরঃ ১৭ বার সংবিধান সংশোধন ও আমাদের জাতীয় সংগীত!

স্বাধীনতার ৫৩ বছরঃ ১৭ বার সংবিধান সংশোধন ও আমাদের জাতীয় সংগীত!

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
সংবিধান সংশোধনের কথা শুনলে যাদের গাত্রদাহ, তাদের উদ্দেশ্যে আমার এ লেখা। বাংলাদেশের ৫৩ বছরে দেশটির সংবিধানে কাটাছেঁড়া, অপারেশন করা হয়েছে ১৭ বার। রাতারাতি সংসদীয় ব্যবস্থা পাল্টে দিয়ে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা যেমন প্রবর্তন করা হয়েছিল, অন্যদিকে দু’বার সামরিক শাসনকে বৈধতা দেয়া হয়েছিল সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে।

সামরিক শাসকের ছাতার তলায় ‘নির্বাচিত’ সংসদে সংবিধান সংশোধন করে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসাবে ঘোষণা করা হয় ১৯৮৮ সালে। পরে রাজনৈতিক সরকারগুলো বিভিন্ন সংশোধনী আনলেও তারা রাষ্ট্রধর্মের জায়গায় আর হাত দেয়নি।

বিশ্বের অনেক দেশেই জাতীয় সংগীত পরিবর্তন হয়েছে নানা প্রেক্ষাপটে। লিঙ্গবৈষম্য, ভাবমূর্তি পরিবর্তনসহ বিভিন্ন কারণে অনেক দেশ তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনেছে। রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, অস্ট্রিয়া, কানাডা, নেপাল, আফগানিস্তান, রুয়ান্ডা, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রমুখ।

প্রত্যেক দেশের জাতীয় সংগীত তার পরিচয়, ইতিহাস এবং জাতির গভীর আবেগের প্রতীক। জাতীয় সংগীত কেবল একটি গান নয়, এটি একটি দেশের নাগরিকদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য, তাদের গৌরবময় অতীতকে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার জন্য এবং ভবিষ্যতের পথে চলার প্রেরণা দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

তবে, বাংলাদেশের বর্তমান জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা’ এক্ষেত্রে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। তবে পরিবর্তন প্রস্তাব নিয়ে যেসকল নেটিজেনরা বিরোধিতা করছেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের পুরো সত্যকে প্রতিফলিত করতে সক্ষম হয়নি।

গত ৫৩ বছর ধরে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের এই দ্বৈত পরিচয়ের বিষয়টি জাতিগত, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বারবার। যখন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের কথা আসে, তখন এটি একটি স্বাধীন জাতির আত্মপরিচয় এবং আত্মমর্যাদার প্রতীক হতে হবে। ‘আমার সোনার বাংলা’ গানে যেমন আমাদের মাটির প্রতি গভীর ভালোবাসা রয়েছে, তেমনি এটি আমাদের আত্মত্যাগ, সংগ্রাম ও স্বাধীনতার জন্য যে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছে, তার সঠিক প্রতিফলন ঘটাতে মোটেই সক্ষম নয়।

গণতন্ত্রের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের বিজয়ের পর ৯০ এর দশকের শুরুতে দেশে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা হয়। নির্বাচনী ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে রাজনৈতিক সরকারের বদলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা চালু করা হয়েছিল। আবার পরে পাল্টা সংশোধনী এনে সেই তত্ত্ববধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর অনেক দ্রুততার সাথে সংবিধান প্রণয়ন করা হয়েছিল। এত অল্প সময়ে আর কোন দেশে সংবিধান প্রণয়নের নজির নেই বলে বলা হয়ে থাকে।

তবে সংবিধান সংশোধনী নিয়ে এখনও তর্ক বিতর্ক রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংসদেই সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে চার বার। বেশিরভাগ সংশোধনী হয়েছে ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তি এবং দলের রাজনৈতিক স্বার্থে এবং সেজন্য অনেক ক্ষেত্রে মানুষের মৌলিক অধিকার সংকুচিত হয়েছে।

প্রথম সংশোধনী আনেন রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসে ৭ মাসের মধ্যেই শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিশ্চিত করা নিয়ে।
দ্বিতীয় সংশোধনী আনা হয় মৌলিক অধিকার স্থগিত এবং জরুরি অবস্থা নিয়ে। শুরু হয় বিরোধী দমন, পীড়ন, ডিটেনশন ও জরুরী অবস্থার নামে প্রহসন।
তৃতীয় সংশোধনী আনা হয় বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমানা নির্ধারণ সর্ম্পকিত একটি চুক্তি বাস্তবায়ন করার জন্য। দুই দেশের সীমান্ত চুক্তিতে ছিটমহল এবং অপদখলীয় জমি বিনিময়ের কথা ছিল। দাদাদের স্বার্থ রক্ষায় তা বহমান। এই সংশোধনী আনার ৪০ বছর পর ২০১৫ সালের জুলাই মাসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ছিটমহলগুলো বিনিময় হয়েছে।

চতুর্থ সংশোধনী আনা হয় একদলীয় শাসন বাকশাল।এই সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থাকে আমূল বদলে ফেলা হয়েছিল। চারটি পত্রিকা রেখে অন্য সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।সেই শাসন ব্যবস্থা বাকশাল নামে পরিচিত। তখনকার সরকারি দল আওয়ামী লীগেরই দু’জন সংসদ সদস্য অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল এম এ জি ওসমানি (মুক্তযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক) এবং মঈনুল হোসেন সংসদে ভোটের সময় অধিবেশন বর্জন করেছিলেন। তবে সব রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত করে বাকশাল প্রতিষ্ঠার পর তা পুরোপুরি কার্যকর হওয়ার আগেই পট পরিবর্তন হয়। উনিশ’শ পঁচাত্তর সালের ১৫ই অগাষ্ট সেনাবাহিনীর এক দল সদস্য শেখ মুজিবকে স্বপরিবারে হত্যা করে।

পঞ্চম সংশোধনী হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পর সামরিক শাসন জারি করে তার বৈধতা দেয়। কী মজা দেখা গেল! জিয়াউর রহমানের সরকার সেখানে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমেই ‘বিসমিল্লহির রাহমানির রাহিম’ যুক্ত করে। তবে দীর্ঘ সময় পর ২০১০ সালে উচ্চ আদালতের এক রায় এই পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেন।

ষষ্ঠ সংশোধনী: বিচারপতি সাত্তারের রাষ্ট্রপতি হওয়ার পথ নিশ্চিত করা হয়েছিল।

সপ্তম সংশোধনীতে বৈধতা পায় এরশাদের সামরিক শাসন।

অষ্টম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম এবং এই সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের ধর্ম নিরপেক্ষতার নীতি পুরোপুরি পাল্টে দেয়া হয়। অষ্টম সংশোধনীতে আরেকটি বড় বিষয় আনা হয়েছিল। সেটি হচ্ছে ঢাকার বাইরে হাইকোর্টের ছয়টি স্থায়ী বেঞ্চ স্থাপন করা।

নবম সংশোধনী: একজন কতবার রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন। এর ফলে রাষ্ট্রপতি পদে কোন ব্যক্তি পর পর দুই মেয়াদের বেশি থাকতে পারবেন না।

দশম সংশোধনীতে আনা হয় রাষ্ট্রপতি নির্বাচন। রাষ্ট্রপতির কার্যকালের মেয়াদ শেষ হওয়ার ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার বিধান আনা হয়েছিল এই সংশোধনীতে।

একাদশ সংশোধনীতে আনা হয় বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের দায়িত্ব নিয়ে। সে সময় আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিসহ আন্দোলনকারী সব দলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে সেই অস্থায়ী সরকার গঠন করা হয়েছিল।

দ্বাদশ সংশোধনীতে আবার সংসদীয় পদ্ধতিতে ফেরত আনা হয়। দীর্ঘ ১৬ বছর পর রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা পাল্টিয়ে সংসদীয় সরকার পদ্ধতি পুনরায় প্রবর্তন করা হয় দ্বাদশ সংশোধনীর মাধ্যমে।

ত্রয়োদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়েছিল। নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তিন মাস মেয়াদের ‘নির্দলীয়’-‘নিরপেক্ষ’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল।

চতুর্দশ সংশোধনীতে সংরক্ষিত মহিলা আসন ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪৫টি করা হয়েছিল। তবে এই সংশোধনীর মাধ্যমে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতিদের অবসর নেয়ার বয়স ৬৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ বছর করা হয়েছিল। সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সব প্রতিষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর ছবি প্রদর্শনের বিধানও করা হয়েছিল এর মাধ্যমে।

পঞ্চদশ সংশোধনীতে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে ২০১১ সালে এই সংশোধনীর মাধ্যমে ১৯৭২ সালের সংবিধানের মৌলিক কিছু বিষয় ফিরিয়ে আনা হয়।

ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়। কী মজা দেখা গেল। পরে তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সাথে আওয়ামী লীগ সরকারের দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। বিষয়টি সকলেই জানেন।

সর্বশেষ সপ্তদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন আরও ২৫ বছর বহাল রাখার বিধান আনা হয়।

আমাদের সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৭খ-তে ৪নং অনুচ্ছেদকে (যেখানে জাতীয় সঙ্গীতের বিষয় বলা আছে) সংশোধন অযোগ্য করা হয়েছে। ফলে পরবর্তী সংশোধনের মাধ্যমে প্রস্তাবনা ও কন্ঠভোটে পাস হওয়া এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, পিএইচডি গবেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

 

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel