সংবিধান সংস্কারঃ সংশোধন না-কি পুনর্লিখন?
সহস্র লাশের বিনিময়ে গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এক নতুন বাংলাদেশের সূচনা হলেও বিপ্লব এখনো ধরা দেয় নাই। সফল বিপ্লব তখনই বলা যায় যখন আন্দোলনের উদ্দেশ্য বাস্তবে প্রতিফলিত হয়। এক ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিতাড়িত করে নতুনভাবে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সাংবিধানিক ভাবে আইনগত বৈধতা পায় নাই। স্বাধীনতাত্তোর মোট পাঁচ বার অসাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েছে। প্রথমত, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্ব পরিবারে হত্যা করার পর সর্বপ্রথম খন্দকার মোশতাক অসাংবিধানিক ভাবে জনগণের মাথায় চেপে বসে। দ্বিতীয়ত, ১৯৭৫ সালের ৭ ই নভেম্বর অভ্যুথানের পর শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতায় বসেন। তৃতীয়ত, ১৯৮৫ সালের ২৪ ই মার্চ হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রপতি আব্দুস সাত্তারকে হটিয়ে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেন। চতুর্থত, ১৯৯০ সালের ৬ ই ডিসেম্বর হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পতনের পর বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করেন, যা সাংবিধানিক বৈধতা পায় নাই। পঞ্চমত, ১/১১ এর ফখরুদ্দিন আহমেদের তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার অবৈধ বলে বিবেচিত হয়।
গত ৫ ই আগস্ট ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর ডকট্রিন অব ন্যাসেসিটির ভিত্তিতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। আমরা মনে করছি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনআকাঙ্খার প্রতিফলন বিধায় সাংবিধানিক আইনে বৈধতার প্রশ্ন তোলা যাবে না। এটা চরম সত্য কথা। যেহেতু সংবিধান হলো আপামর জনতার ইচ্ছার প্রতিফলন সেহেতু জনতার সরকারকে আইনগত ভাবে বৈধতা দিতে হয় না। কেননা আইন জনগণের জন্য, আইনের জন্য জনগণ নয়। গণ-অভ্যুত্থানের ফলে দেশের সংবিধান অকার্যকর হয়ে পড়লেও আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কিন্তু এই সংবিধানের অধীনেই শপথ গ্রহণ করেছেন৷ যেহেতু সংবিধানের অধীনে শপথ নেয়া হয়েছে সেহেতু সংবিধান বহাল রয়েছে বলে ধরে নিতে হবে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা ও অবৈধতার প্রশ্ন ততক্ষণ থেকে যাবে যতক্ষণ পর্যন্ত সংবিধান নিয়ে কোনো সুরাহা না হবে। সেজন্য সকল নাগরিকের প্রথম দায়িত্ব হলো সংবিধান বিষয়ে যুগোপযোগী সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া, যাতে আগামী দিনে জুলাই আন্দোলনের স্পৃহা স্তিমিত না হয় এবং অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বিতর্কিত না হয়ে থাকেন।
সংবিধান বিষয়ে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক প্রশ্ন হলো, সংবিধান কি সংশোধন হবে নাকি পুনর্লিখন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে ১৯৭২ সালের ১৬ ই ডিসেম্বর থেকে ২০২৪ সালের ৩৬ ই জুলাই তথা ৫ ই আগস্ট পর্যন্ত বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদেরকে দেখতে হবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে আসলেই জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে কি-না? এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার আগে আমরা বাংলাদেশের নাম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে চাই। এই যে, “গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ” এর মধ্যে রাজা-প্রজার একটা প্যাঁচগোচ বাঁধিয়ে দেয়া হয়েছে সেটার সমাধান কি? এখানে রাজা কে আর প্রজা কে? রাজা কে তাহা জানিনা তবে জনগণ যে প্রজা এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ আমরা রাখি না৷ সংবিধানে বলা হয়েছে জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস৷ আচ্ছা, যারা সর্বময় ক্ষমতার উৎস, তারা প্রজা হয় কি করে? এই দোদুল্যমান প্রশ্নের জবাব খোদ সংবিধান প্রণেতা ড.কামাল হোসেন স্যার দিতে পারবেন কি-না সন্দিহান। যে নাম সরকার ও জনতার মধ্যে রাজা-প্রজা রীতি যুক্ত করে মনঃস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে তার সংশোধন জরুরি নয় কি?
দেশের সকল কাঠামো পরিবর্তনের অঙ্গীকার করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এখন কোন উপায়ে সে সকল কাঠামো পরিবর্তন হবে তা বড় প্রশ্নের উদ্ভব ঘটিয়েছে? সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গুলো সাংবিধানিক উপায়ে পরিবর্তন করতে গেলে পুনরায় স্বৈরাচার জন্ম নিবে আবার সাংবিধানিক উপায় অবলম্বন না করলে কোন উপায়ে প্রতিষ্ঠান গুলো পুনর্গঠন করবে? এমতাবস্থায় সবার আগে সংবিধান সংশোধন/পুনর্লিখন করতে হবে। অতঃপর নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলতে হবে রাষ্ট্রের সকল কাঠামো।
সংবিধান পুনর্লিখন না-কি সংশোধন তা নির্ধারণের জন্য বর্তমান সংবিধান ও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার দিকে নজর দিতে হবে। আমরা যদি আওয়ামী ফ্যাসিস্ট সরকারের বিগত ১৬ বছরের দিকে দৃষ্টি দেই, তাহলে দেখবো ফ্যাসিস্ট সরকার তাদের সকল অপকর্ম সংবিধান দ্বারা বৈধতা দিয়েছে। তারা নিজেদের প্রয়োজনে তথাকথিত সংসদ ও গৃহপালিত বিচারপতিদের মাধ্যমে শেখ হাসিনার আকাঙ্খা আলোকে সময়ে সময়ে সংবিধান পরিবর্তন করেছে। আমরা বর্তমান সংবিধান দ্বারা শেখ হাসিনাকে কোনোভাবেই স্বৈরাচার বলতে পারি না। শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় ভ্যানগার্ড হলো বর্তমান সংবিধান। যে সংবিধান শেখ হাসিনার মতো খুনী ও ফ্যাসিস্ট জন্ম দেয় সেই সংবিধান দিয়ে কোনো সভ্য ও কল্যাণ রাষ্ট্র চলতে পারে না।
বর্তমান সংবিধান জনআকাঙ্খার প্রতিফলন থেকে শত-দূরে অবস্থান করায় এবং ১৯৭২ সালের পর থেকে অদ্যাবধি পর্যন্ত মানুষের ইচ্ছার প্রতিফলন না ঘটায় এই সংবিধান অপ্রয়োজনীয় পুস্তক বলে বিবেচিত হয়। এই সংবিধানের অধীনে যত নির্বাচন সংগঠিত হয়েছে তার সব গুলোই বিতর্কে জড়িত। আমরা এমন কোনো নির্বাচন দেখি নাই, যেখানে পরাজিত দল বিজয়ী দলকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। বরং প্রতিটা নির্বাচনের পরই পরাজিত দল বিজয়ী দলকে কারচুপির দায়ে অভিযুক্ত করেছে। যে সংবিধান জনগণের প্রধানতম নাগরিক অধিকার তথা নির্বাচনে পূর্ণ স্বচ্ছতা দিতে পারে নাই সে সংবিধান সংশোধন করে খুব বেশি দূর এগোনোর পথ যে রুদ্ধ হয়ে গেছে তা সহজেই অনুমেয়।
সংবিধান পুনর্লিখন না করে সংশোধনের মাধ্যমে রাষ্ট্র গঠন সম্ভব বলে বড় একটি মহল আলোচনা করছেন। তাদের প্রতি সম্মানপূর্বক প্রশ্ন রাখতে চাই যে, সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণকারী সংসদ এবং সংবিধান রক্ষার অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে সংবিধানের অধীনে শপথ গ্রহণকারী বিচারপতিগণ কি সংবিধান সংশোধনের ক্ষমতা রাখেন? সংবিধান বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রদান ব্যতিত আদালতের আর কোনো ক্ষমতা রয়েছে কি? সংসদ চাইলেই কি জনআকাঙ্খার সংবিধান সংশোধন করতে পারে? সংবিধান দ্বারা সংসদ নিয়ন্ত্রিত না-কি সংবিধান সংসদের মুখাপেক্ষী? সংবিধান অসীম ক্ষমতা দ্বারা সৃষ্ট, তবে সেই অসীমের কাজে হাত দেয়ার ক্ষমতা সসীম সংসদের রয়েছে কি? রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে নিজেদের মতো সংবিধান সংশোধন করলে কিছু দিন পর অন্য দল ক্ষমতায় গেলে সংবিধান পরিবর্তন করবে না, এমন কোনো নিশ্চয়তা আছে? যদি নিশ্চয়তা না থাকে তাহলে এমন সংশোধনী গুরুত্ব পায় কি? এতদ প্রশ্ন গুলোর উত্তর পাওয়া দুষ্কর। হয়তো কেউ কেউ নানান যুক্তি নির্ভর উত্তর দিতেও পারেন কিন্তু আদতে জনগণের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতমূলক জবাব আসবে না।
তবুও যুক্তির খাতিরে ধরে নিলাম সংবিধান সংশোধন করেই রাষ্ট্র পুনর্গঠন সম্ভব, তাহলে সংবিধানের দিকে নজর দিতে হয়। কিন্তু বর্তমান সংবিধান কি সংশোধনের কোনো পথ খোলা রেখেছে? না, সংশোধনের কোনো পথ উন্মুক্ত নেই। সংশোধনের সবচেয়ে বড় বাঁধা হলো অনুচ্ছেদ ৭খ। তাছাড়া সংবিধানে এতোবেশি অসঙ্গতি যে সংশোধন করতে গেলে তিন-পঞ্চমাংশ সংশোধন করা প্রয়োজন। এতো বেশি সংশোধন করা হলে তখন কি আর তা সংশোধন থাকে?
আমরা যদি শুধুমাত্র সংবিধানের প্রস্তাবনা ও প্রথম ভাগে নজর দেই তাহলে যেসব অসঙ্গতি দেখি তা হলো, প্রস্তাবনার ২য় প্যারায় বলা হয়েছে “আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রাণোৎসর্গ করিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিল -জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার সেই সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূলনীতি হইবে।” এখানে যেসকল মূলনীতি সমূহকে বীর শহীদদিগকে প্রাণ বিলিয়ে দিতে উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলো বলে উল্লেখ করা হয়েছে তা পুরোপুরি অসত্য, মিথ্যা ও বানোয়াট। তখনকার মানুষ এই নীতি সম্পর্কে কোনরূপ জ্ঞান রাখতো কি-না তাহাও সন্দিহান। তাছাড়া সেগুলো যদি আসলেই মুক্তিযোদ্ধাদের আদর্শের ভিত্তি হতো তাহলে নিশ্চয়ই তা ৭২ সালে সংবিধানে যুক্ত করা হতো। সংবিধান সংশোধন করে অন্তর্ভুক্ত করা লাগতো না।
অনুচ্ছেদ ২ক. এ রাষ্ট্রধর্ম নির্ধারণ করা হয়েছে আবার অনুচ্ছেদ ৮ ও ১২ তে ধর্মনিরপেক্ষতা জুড়ে দেয়া হয়েছে। যা পরস্পর সাংঘর্ষিক। হয়তো রাষ্ট্রধর্ম থাকবে নয়তো থাকবে ধর্মনিরপেক্ষতা। দুটোতো একত্রে চলতে পারে না।
অনুচ্ছেদ ৪ক তে জাতির পিতার প্রতিকৃতি অফিস-আদালতে ঝুলিয়ে রাখার বিধান অন্তর্ভুক্ত করে জাতির সাথে রীতিমতো তামাশা করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদ দ্বারা কি বঙ্গবন্ধুকে দেবতার সাথে তুলনা করা হয় নাই? এসব অনুচ্ছেদ সংবিধানে স্থান পাওয়া কতটুকু যৌক্তিক?
অনুচ্ছেদ ৬ (২) এ বলা হয়েছে, “বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।” আচ্ছা, এই অনুচ্ছেদে যে সকল জনগণকে বাঙ্গালী হিসেবে পরিচিত হওয়ার কথা উল্লেখ হয়েছে, এই দেশে কি বাঙ্গালী ব্যতিত অন্য কোনো জাতি বসবাস করে না? অন্যান্য জাতি থাকলে তাদের জন্য এই অনুচ্ছেদ কিভাবে বিবেচিত হবে?
অনুচ্ছেদ ৭৷ (১) বলা হয়েছে, “প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ; এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে”। এই অনুচ্ছেদে জনগণকে সকল ক্ষমতার মালিক বলে ধরা হয়েছে। তারমানে এই সংবিধান সূত্রে জনগণ অসীম ক্ষমতার অধিকারী। অথচ এই অসীম ক্ষমতার অধিকারী জনগণের ক্ষমতার প্রয়োগকে সংবিধান দ্বারা সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ক পুরোনো আলাপ। সেই কাসুন্দি না ঘাঁটলেও সবারই এটি জানাশোনায় আছে। আর অনুচ্ছেদ ৭খ তো স্বয়ং সংবিধানের প্রায় এক-তৃতীয়াংশকে সংশোধন করার পথই প্রায় রুদ্ধ করে দিয়েছে। এভাবে ধরে ধরে সংশোধন করতে গেলে দেখা যাবে সংশোধনের নামে সংবিধানের অস্তিত্বই হারিয়ে গেছে। অবশ্য আমাদের ১৯৭২ সালের সেই সংবিধান আদৌ আছে কি আজকে? ১৫তম সংশোধনে অন্তত ৫০টি জায়গায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তাহলে ১৯৭২-এর সংবিধান কোথায়? আমরা যদি পেছনের দিকে যেতে চাই, তাহলে চতুর্থ সংশোধনে গিয়ে ধাক্কা খাব। যেখানে বাকশালের কথা বলা হয়েছে। আমরা ধারাবাহিকভাবে সংবিধান বিশ্লেষণ করলে দেখবো সংবিধানে জনগণকে জিম্মি করে রাখার প্রক্রিয়া সুকৌশলে যুক্ত করে রাখা হয়েছে।