শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৬ অপরাহ্ন
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
একথা সবাই জানেন যে, দাবী আদায়ের প্লাটফর্ম আদালত নয়। বিচারক আসামীকে জামিন দিয়েছেন। সেকারণ তাঁর পদত্যাগের দাবীতে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আদালতের সামনে বিক্ষোভ করবেন, বিষয়টি মোটেই শোভনীয় নয়। স্বাধীন বিচার বিভাগে নগ্ন হস্তক্ষেপের একটি জ্বলন্ত উদাহরণও বটে। আমি কারও পক্ষে-বিপক্ষে লিখছি না। আইনের কথা বলছি মাত্র।
জামিন অর্থ আইনগত হেফাজত থেকে কোন ব্যক্তিকে ছেড়ে দেওয়া। আরও সহজ করে বলতে গেলে, কোন লোককে পুলিশের হেফাজত হতে মুক্ত করে জামিনদারের হাতে অর্পণ করা। আর জামিনদার এমন লোক যিনি আদালত যখনই আবশ্যক মনে করেন তখনই আসামীকে আদালতে হাজিরা করার প্রতিশ্রুতি দেন। (৫ ডিএলআর ১৫৪)।
ফৌজদারী মামলায় জামিন মঞ্জুর কিংবা না-মঞ্জুর সহ জামিন সংক্রান্ত বিভিন্ন বিধানবলী ফৌজদারী কার্যবিধির ৪৯৬, ৪৯৭, ৪৯৮ এবং ৪৯৮ (এ) ধারা সমূহে উল্লেখ আছে। আইনের ভাষায়, কোনো ব্যক্তিকে আদালত কর্তৃক দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত তাকে নির্দোষ বলে ধরে নিতে হবে। বিচার শেষ হওয়ার আগে যেহেতু কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা যাবে না, সেহেতু ওই ব্যক্তি জামিন পাওয়ার কিছু আইনগত অধিকার রয়েছে। যেমন জামিনযোগ্য অপরাধে কোন অভিযুক্ত ব্যক্তি জামিননামা দিতে প্রস্তুত থাকা মাত্র যে পুলিশ কর্মকর্তা বা আদালতের কাছে তিনি জামিন দেওয়ার প্রস্তাব করেন ওই কর্মকর্তা বা আদালত শর্ত মোতাবেক তাকে জামিন দিতে বাধ্য থাকেন। গ্রেপ্তারকৃত কোন ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া যাবে না এমন বিধান ফৌজদারি কার্যবিধিতে নেই।
তবে অপরাধ বিবেচনায় জামিন অযোগ্য ধারার মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তির জামিনের বিধান ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলে দেওয়া হয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ ধারার (১) উপধারায় বলা হয়েছে, মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় কোন অপরাধে অপরাধী বলে বিশ্বাস করার মতো যুক্তিসংগত কারণ থাকলে তাকে মুক্তি দেওয়া যাবে না।
৪৯৭ এর (২) ধারায় বলা হয়েছে, তদন্ত অনুসন্ধান বা বিচারের কোনো পর্যায় আদালতের নিকট বা পুলিশ কর্মকর্তার নিকট যদি প্রতীয়মান হয় যে, জামিন অযোগ্য ধারায় অপরাধ করেছে বলে বিশ্বাস করার মত যুক্তিসংগত কারণ নেই তাহলে তাকে জামিন দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। জামিনের বিষয়ে আদালতের বিবেচনামূলক ক্ষমতা সম্পর্কে ৪৯৭ ধারার ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, অভিযুক্ত ব্যক্তির পালানোর সম্ভাবনা আছে কি-না, সাক্ষীদের ভয়-ভীতি দেখিয়ে অভিযুক্তের পক্ষে সাক্ষ্য জালিয়াতি করার কোনো সম্ভাবনা আছে কি-না, উভয় পক্ষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় কি-না তা আদালতকে বিবেচনা করতে হবে।
এমনকি মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড যোগ্য অপরাধ সংগঠিত করেছে কেবলমাত্র এই কারণে তাদেরকে কারাগারে রাখার কোনো আইনগত বা নীতিগত বাধ্যবাধকতা নেই। আইনে বলা হয়েছে, জামিনযোগ্য ধারায় জামিন দিতে হবে।
পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, কুষ্টিয়ার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মাহমুদা সুলতানার পদত্যাগ দাবিতে আদালত চত্বরে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন একদল মানুষ। ২৩ সেপ্টেম্বর সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যানারে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ভবনের সামনে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্লোগান দেন তারা। ১১টার দিকে বিক্ষোভকারীরা মিছিল করে আদালত চত্বর প্রদক্ষিণ করেন।
গত ১৯ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামের জিলহজ্ব হোসেন বাদী হয়ে তার ভাই জনিকে হত্যা চেষ্টার অভিযোগে মামলা করেন। ওই মামলায় ৭৮ জনকে আসামি করা হয়। মামলার দিনই কুষ্টিয়া পৌরসভার তিন কাউন্সিলরকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। পরে আরও তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদেরকে রোববার জামিন দেন মাহমুদা সুলতানা।
কিন্তু আদালত কর্তৃক জামিনপ্রাপ্ত আসামীদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট মামলায় সুনির্দিষ্টভাবে হত্যা চেষ্টার অপরাধ দ-বিধির ৩০৭ ধারার অভিযোগ না থাকায় আদালত আইন অনুযায়ী জামিন প্রদান করে থাকেন। আইন বলছে, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকতে হবে সুনির্দিষ্টভাবে। দ-বিধির ৩০৭ ধারায় অপরাধ প্রতিষ্ঠার জন্য আসামী কর্তৃক কৃতকার্যের ধরণ বা প্রকৃতি, আসামীর উদ্দেশ্য এবং অভিপ্রায় থাকতে হবে। এগুলো অনুপস্থিত থাকলে উক্ত আসামী জামিন পেতে হকদার। কাজেই জামিন বিষয়ে বিচারকের প্রতি সংক্ষুব্ধ হলে বিক্ষোভ নয়, আইন অনুযায়ী আপিল, রিভিশন করার সুযোগ রয়েছে। সংক্ষুব্ধ পক্ষের দাবী প্রতিষ্ঠায় অনেকগুলো আইনী পথ খোলা রয়েছে। আসুন বিক্ষোভ নয়, পদত্যাগ দাবী নয়। আমরা আইন অনুযায়ী ন্যায্য দাবী বুঝিয়ে নিই, অধিকার প্রতিষ্ঠা করি, আরও সহনশীল হই।। সকল পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইনগবেষক। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮