শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৬ অপরাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
ডাঃ সাবরিনা ও চিকিৎসকদের অপকর্মের আইনগত প্রতিকার

ডাঃ সাবরিনা ও চিকিৎসকদের অপকর্মের আইনগত প্রতিকার

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:

চিকিৎসা সেবায় বাংলাদেশ চরম ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। বিনা চিকিৎসায় ও চিকিৎসা অবহেলায় জীবন দিতে হচ্ছে অসংখ্য মানুষকে। ডাঃ সাবরিনা, জেকেজি হাসপাতাল, রিজেন্ট সাহেদরা রয়েছে হাজারে হাজারে। জরিপে আসছে, মানুষ এখন সবচেয়ে বেশী ধোকা ও প্রতারণার শিকার হচ্ছে চিকিৎসা সেবায়। আপনি চিকিৎসা সেবায় অবহেলা, প্রতারণা বা ধোকার শিকার হলে কি করবেন, কোথায় যাবেন, আইনগতভাবে চিকিৎসক ও হাসপাতালের বিরুদ্ধে কি ব্যবস্থা নিতে পারবেন-তা নিয়েই আমাদের আজকের আলোচনা।

আমাদের দন্ডবিধি আইনে ষ্পষ্ট বলা আছে, যদি কোনো ব্যক্তির অবহেলা বা ইচ্ছাধীন কাজের মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির মৃত্যু ঘটান, তবে সে ব্যক্তি দ-বিধির ৩০৪(ক) ধারার অপরাধ করেছেন মর্মে গণ্য হবেন।কাজেই যখন কোনো রোগী চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন এবং চিকিৎসক ওই রোগীর চিকিৎসার দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন চিকিৎসকের অবহেলায় রোগীর মৃত্যু সংঘটিত হলে চিকিৎসক ৩০৪(ক) ধারার দায় কোনোভাবেই এড়াতে পারেন না। কারণ চিকিৎসকও আইনের উর্ধ্বে নন। আর প্রমাণ করতে পারলেই চিকিৎসকের পাঁচ বছর মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদন্ড, অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডে দন্ডিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একজন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় তাঁর আশ্রয়ের সর্বশেষ স্থল হিসেবে একজন চিকিৎসকের কাছে যান। তিনি আমা করেন তাঁর চিকিৎসক সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাঁকে সারিয়ে তুলবেন এবং বাঁচিয়ে রাখবেন। রোগী চিকিৎসকের ওপরে চূড়ান্ত আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করেন।

 

১৯৮৬ সালের কনজিউমার প্রোটেকশন অ্যাক্ট নামে একটি আইন রয়েছে। ডাক্তারের অবহেলার ফলে কোনো রোগী ক্ষতিগ্রস্ত হলে কনজিউমার কোর্টে গিয়ে অভিযোগ জানাতে পারেন। এ কোর্টে কোনো কোর্ট ফি লাগে না। ফলে দরিদ্র রোগীরাও এখানে বিচারের জন্য আসতে পারে। তবে আপাতত জনস্বার্থে মামলার মাধ্যমে সরাসরি হাইকোর্টে গিয়ে কিছু ক্ষেত্রে কার্যকর সমাধানের চেষ্টা করা যায়। একই সঙ্গে ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালতে যেটুকু আইনগত সুবিধা রয়েছে তার সর্বোচ্চ সুযোগ নেয়া উচিত। চিকিৎসায় অবহেলায় অপরাধের ক্ষেত্রে হটকারিতা, অসতর্কতা, অবহেলা বা বেপরোয়া কাজ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়। রশিদুল্লাহ বনাম রাষ্ট্র (২১) ডিএলআর (৭০৯) মামলায় বলা হয়েছে, বেপরোয়া বা হটকারি কাজ মানে হচ্ছে কোনো বিপজ্জনক কাজের ঝুঁকি নেওয়া এবং সতর্কতার সঙ্গে কাজটি সম্পাদন করা। ডাক্তারি অবহেলাও দন্ডবিধির এ ধারায় অন্তর্ভূক্ত হবে। এছাড়া ৩১৪ ধারায় গর্ভপাত-সংক্রান্ত অপরাধের কথা বলা হয়েছে। গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে যদি মৃত্যু ঘটায় তাহলে এ ধারা অনুযায়ী ডাক্তারের ১০ বৎসর পর্যন্ত জেল হতে পারে। তবে ৩৩৮ ধারাটি ডাক্তারি অবহেলা-সংক্রান্ত অপরাধ প্রতিকারের ক্ষেত্রে বেশ সামঞ্জস্যপূর্ণ। এ ধারায় উল্লেখ আছে, যে কোনো ধরণের বেপরোয়া কাজ বা অবহেলার কারণে আঘাত দিলে সর্বোচ্চ দুই বছরের কারাদন্ড বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা অর্থদ- অথবা দুটি একসঙ্গে দেওয়া যাবে।

এছাড়া বাংলাদেশে দ্য মেডিকেল প্রাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস্ অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেজিষ্ট্রেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২ নামে একটি আইন আছে। যাতে ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের ক্ষেত্রে এবং প্রাইভেট ক্লিনিক স্থাপন ও পরিচালনায় সুষ্পষ্ট নিয়ম প্রণয়ন করা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী কোনো সরকারী চাকুরিতে নিযুক্ত আছেন, এমন কোনো রেজিষ্টার্ড চিকিৎসক অফিস চলাকালীন কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা নার্সিং হোমে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন না, প্রাইভেট ক্লিনিকের মালিক বা পার্টনার হতে পারবে না এবং করলে তাঁর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। অপারেশনের ফিসসহ বিভিন্ন কারণে ভর্তি হওয়া রোগীদের কাছ থেকে কী পরিমাণ ফি নির্ধারণ করা হবে, তা এ আইনে উল্লেখ আছে, যা সচরাচর মানা হয় না। যেমন আইনে সিজারিয়ান অপারেশনের ক্ষেত্রে ৪০০ টাকা ফি নির্ধারণ করা থাকলেও বাস্তবে বহুগুণ বেশী আদায় করা হচ্ছে। এ আইনের ১৩ ধারায় বলা হয়েছে, এ অধ্যাদেশের বিধান লংঘন করা হলে ছয় মাস পর্যন্ত কারাদন্ড বা পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা।

 

একটা কথা জেনে রাখা দরকার যে, ডাক্তারি অবহেলা বলতে শুধু ডাক্তারদের অবহেলা নয়, এর সঙ্গে আনুষঙ্গিক ব্যবস্থা, নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ টেকনিশিয়ান, ওষুধ সরবরাহ ও সরবরাহকারীদের অবহেলা প্রভৃতিও বোঝানো হয়। ডাক্তারদের যে সব আচরণ অবহেলা হিসেবে গণ্য হয়, সেগুলোর মধ্যে রোগীকে সঠিকভাবে পরীক্ষা না করা, ভুল ঔষধ বা ইনজেকশন প্রয়োগ, ভুল অপারেশ করা, অস্ত্রপাচারের উপকরণ রোগীর শরীরের ভেতর রেখে দেওয়া প্রভৃতি। এ ছাড়া রোগীর সঙ্গে দূর্ব্যবহার, ফি নিয়ে দরকষাকষিও চিকিৎসকদের অবহেলার মধ্যে পড়ে। অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার সরকারী হাসপাতালে কর্তব্য পালন অবস্থায় প্রাইভেট ক্লিনিকে কর্মরত থকেন, যা একটি অপরাধ। আবার অনেকেই নিজেদের উপার্জিত ডিগ্রির পাশে অনেক ভূয়া বিদেশী ডিগ্রি জুড়ে দেন, যা অন্যায় ও প্রতারণার শামিল। ডাক্তারি রিপোর্ট বা পোস্টমর্টেম রির্পোটে ভুল উপায় সংযোজন করা, মনগড়া রিপোর্ট ও জালিয়াতি করা একটি অপরাধ। এ ছাড়া রোগীর মূল দলিল দিতে অবাধ্যতা, বারবার রোগীকে হেনস্থা করা, হাসপাতালের প্রয়োজনীয় সিট না বরাদ্দ দিয়ে অন্যত্র ব্যবস্থা করা প্রভৃতিও অবহেলা-সংক্রান্ত অপরাধের শামিল।

সবিশেষ চিকিৎসকদের সমীপে নিবেদন, দেশে চিকিৎসাসেবার নামে যা চলছে তা কি চলতে দেয়া যায়? আপনারা উচ্চশিক্ষিত মেধাবী সন্তান, নৈতিকতার স্খলনে গা না ভাসিয়ে গণমানুষের সেবা করুন, দেশকে এগিয়ে নিন। নতুবা আপনারাও ডাঃ সাবরিনার মতো আইনের আওতায় আসতে বাধ্য।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel