বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ১০:০৯ অপরাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
তালাক প্রদানে নারীর যত ক্ষমতা!

তালাক প্রদানে নারীর যত ক্ষমতা!

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক

কোনো স্ত্রী যদি যুক্তিসংগত কারণে স্বামীকে তালাক দিতে চান, সে ক্ষমতা প্রচলিত আইনে স্ত্রীর রয়েছে। বিশেষ করে আমাদের আদালতগুলো নারী অধিকার এবং নারীকে স্বতন্ত্রভাবে মূল্যায়ন করতে বেশকিছু যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দিয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের এসব সিদ্ধান্ত অনেক বিতর্কেরও সৃষ্টি করেছে।

মুসলিম আইনে নারীদের হাতে তালাকের বিধান হলো- ক. ‘খুল’ বা ‘খুলা’ তালাক, খ. মুবারাত এবং গ. তালাক-ই-তাওফিজ। প্রচলিত হানাফি আইন অনুযায়ী একজন মুসলিম স্ত্রী শুধু খুলা তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারে। এই তালাকে স্বামী এবং স্ত্রী উভয়ের সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকে। তবে উল্লেখ্য, এই ধরনের তালাকে বিবাহ বিচ্ছেদের জন্য স্ত্রী তার স্বামীকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে থাকে। সাধারণত ক্ষতিপূরণ হিসেবে স্ত্রী তার আর্থিক দাবির কোনো অংশ ত্যাগ করে এবং তখন স্বামী তালাক দেয়ার মাধ্যমে স্ত্রীকে বিবাহবন্ধন থেকে মুক্ত করে দেয়। যদি স্বামী বা স্ত্রী একত্রে শান্তি ও সৌহার্দের মধ্যে বসবাস করতে না পারে সেক্ষেত্রে স্ত্রী তালাকের বিনিময় মূল্য প্রদান করে খুলা তালাক পেতে অধিকারিণী। (শিরিন আলম চৌধুরী বনাম ক্যাপ্টেন শামসুল আলম চৌধুরী ৪৮ ডিএলআর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা-৭৯)।
তবে এ তালাকের উল্লেখযোগ্য দিক হলো-১। স্ত্রী স্বামীকে তালাক দেওয়ার প্রস্তাব দিয়ে থাকেন, ২। স্বামী ওই প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে থাকেন, ৩। স্ত্রীকে তালাক দেওয়ার সময় স্বামী বিনিময়ে স্ত্রীর কাছ থেকে প্রতিদান নিয়ে থাকেন এবং স্ত্রী তা দিয়ে থাকেন বা দিতে সম্মত হন। তবে খোলা তালাকের ক্ষেত্রে অন্য কোনো চুক্তি না থাকলে স্ত্রী মোহরানা পাওয়ার অধিকারী হবেন না; কিন্তু ইদ্দত পালনকালে স্ত্রী তাঁর গর্ভের সন্তানের জন্য স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাওয়ার অধিকারী হবেন।

মুবারাত হলো পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে বিবাহ বিচ্ছেদ। এ ধরনের বিবাহ বিচ্ছেদের বেলায় উভয়ই বিবাহ বিচ্ছেদে সম্মত হয় বলে কাউকে কোনো ক্ষতিপূরণ দেয়া লাগে না। শারিয়া অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্ট ১৯৩৭ এই তালাকের বিধান ছিল। মুবারাত তালাকের প্রচলন খুব একটা নেই বললেই চলে।

সবশেষে তালাক-ই-তাওফিজ বা অর্পিত ক্ষমতাবলে দেয়া তালাক। নিকাহনামা বা কাবিন নামার ১৮ নং কলামে “স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করছে কি না? করে থাকলে কী শর্তে?” এই প্রশ্নটি থাকে। কাবিননামার ১৮ নং ঘরটি এজন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পূরণ করা উচিত। অনেক সময় কাজীরা এ প্রশ্ন করেন না এবং ঘরটি শূন্য থাকে। কাজীদের অবশ্যই দুপক্ষকে দিয়ে ঘরটি সম্পর্কে জানানো উচিত। এই ধরনের তালাকে স্বামী কিছু শর্তসাপেক্ষে তালাক দেয়ার ক্ষমতা স্ত্রীকে প্রদান করে এবং উক্ত শর্ত অনুযায়ী স্ত্রী তালাক প্রদান করতে পারবে।

উল্লেখ্য, মুসলিম আইনে ‘খুলা’ এবং ‘মুবারাত’ ছাড়া সব ক্ষেত্রে তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করার ক্ষমতা একচ্ছত্রভাবে পুরুষের ওপর ন্যস্ত। যদিও কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্ত্রী তালাকের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ করতে পারে তবে তা একচ্ছত্রভাবে নয় বরং স্বামীর সম্মতিসাপেক্ষে।

প্রচলিত মুসলিম আইনে বিবাহ বিচ্ছেদের বেলায় স্বামী-স্ত্রীর অসাম্য দূর করার জন্য ১৯৩৯ সালে পাস করা হয় মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইন। এই আইনে বিভিন্ন কারণে যেমন স্বামী যদি ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হয় বা স্বামী যদি কোনো ফৌজদারি অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত হয় অথবা স্বামী যদি স্ত্রীর সাথে নিষ্ঠুর আচরণ করে তাহলে স্ত্রী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারবে। সুতরাং স্বামী কর্তৃক অর্পিত ক্ষমতাবলে নয় অথবা কোনো প্রকার আর্থিক দাবি ত্যাগ না করে স্ত্রীকে তালাক দেয়ার ক্ষমতা ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের মাধ্যমে প্রদান করা হয়। এমনকি নির্যাতনের ভয়ে স্ত্রী স্বামী গৃহ ত্যাগ করেও দুই বছর ভরণপেষণ না পেয়ে বিয়ে বিচ্ছেদের ডিক্রি পাওয়ার অধিকারিনী। (সালমা খাতুন বনাম মোসলেম উদ্দিন ১৯ ডিএলআর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা-৫৫৩)। তবে দ-াদেশের ক্ষেত্রে দ-াদেশটি চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী বিচ্ছেদের ডিক্রি পাওয়ার অধিকারিণী নয়। (আমেনা খাতুন বনাম সিরাজ উদ্দিন সর্দার ১৭ ডিএলআর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা-৬৮৭)

উল্লেখ্য, মালিকী মতবাদ অনুসরণ করে ‘নিষ্ঠুরতা’ বা ‘অসৌজন্যমূলক আচরণ’কে উক্ত আইনে অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, যার পরিপ্রেক্ষিতে স্ত্রী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করতে পারে। ‘নিষ্ঠুরতা’ শব্দটি ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। বিভিন্ন সময় আমাদের আদালতও ঘোষণা করেছে যে ‘নিষ্ঠুরতা’ বলতে শুধু শারীরিক নির্যাতন বোঝাবে না বরং যে কোনো মানসিক নির্যাতনও নিষ্ঠুরতার অন্তর্ভুক্ত হবে। যেমন, হাসিনা আহমেদ বনাম সৈয়দ আবুল ফজল মামলায় (৩২ ডিএলআর, হাইকোর্ট বিভাগ, ২৯৪) আদালত মন্তব্য করেছেন যে স্ত্রীর অন্য কারো সাথে অবৈধ সম্পর্ক আছে বলে প্রতিনিয়ত দোষারোপ করা হলে স্ত্রী আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারবে। কুতুবউদ্দিন জায়গীরদার মামলায় (২৫ ডিএলআর, হাইকোর্ট বিভাগ, ২১) আদালত মন্তব্য করেছেন যে, নিষ্ঠুরতার (যা মানসিক নির্যাতনকেও অন্তর্ভুক্ত করে) কারণে মুসলিম আইনে বিবাহিত একজন স্ত্রী তার স্বামীকে তালাক দিতে পারবে। এছাড়া হোসনে আরা বেগম মামলায় (৪৩ ডিএলআর, হাইকোর্ট বিভাগ, ৫৪৩) আদালত ‘নিষ্ঠুরতা’ শব্দের একটি ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন। উক্ত ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে যে, ‘নিষ্ঠুরতা বলতে শুধুমাত্র শারীরিক নির্যাতন বোঝাবে না বরং সচ্ছল কোন পরিবারে কোন স্ত্রীকে (যার অভ্যাস নাই) যদি প্রাত্যহিক গৃহকর্ম করতে বাধ্য করা হয় তাহলে তা নিষ্ঠুরতা বলে গণ্য হবে।’শুধু তাই নয় স্ত্রীকে শয্যার ভাগ না দিলে সেটা নিষ্ঠুরতা হিসেবে গণ্য হবে। (আমেনা খাতুন বনাম সিরাজ উদ্দিন সর্দার, ১৭ ডিএলআর (হাইকোর্ট) পৃষ্ঠা ৬৮৭)

মুসলিম আইনের বিভিন্ন মতবাদগুলোর মধ্যে একমাত্র মালিকী মতবাদে স্বামীর নিষ্ঠুরতার জন্য স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদ চাইতে পারে। প্রচলিত হানাফি মতবাদ অনুযায়ী স্বামী যদি ভরণপোষণ দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে স্ত্রী আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারে। অন্যান্য মতবাদেও বিভিন্ন কারণ যেমন স্বামী যদি ভরণপোষণ দিতে অস্বীকার করে অথবা স্বামী যদি পাগল হয় তাহলে স্ত্রী আদালতের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারে।

গত কয়েক দশকে নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের সাথে সাথে বিচার বিভাগের দৃষ্টিভঙ্গিরও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষণীয়। বিশেষ করে ষাটের দশক থেকে, যখন দেনমোহর প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার কারণে স্ত্রী বিবাহ বিচ্ছেদ চাইতে পারে বলে আদালত মত দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে নেলি জামান মামলাটি (৩৪ ডিএলআর, হাইকোর্ট বিভাগ, ২২১) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। উল্লিখিত মামলায় প্রথমবারের মতো সামাজিক পরিবর্তন এবং নারীর স্বাধীনতার ওপর গুরুত্বারোপ করার জন্য আদালত মত প্রদান করেন। আদালত মত প্রকাশ করেন যে, সমাজ পরিবর্তনের সাথে সাথে নারী অধিকারের বিষয়টিও সামনে চলে এসেছে এবং বিবাহের দায়দায়িত্বের ক্ষেত্রেও তাদের স্বাধীন সত্তাকে সম্মান জানাতে হবে।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন গ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

 

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel