শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:০১ অপরাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
তালাক ইস্যুতে সালিস পরিষদের কার্যকারিতা নিয়ে হাইকোর্টের রুল বনাম বাস্তবতা

তালাক ইস্যুতে সালিস পরিষদের কার্যকারিতা নিয়ে হাইকোর্টের রুল বনাম বাস্তবতা

SAMSUNG DIGITAL CAMERA

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: প্রথমেই তালাক সম্পর্কে প্রচলিত ভ্রান্ত ধারনাটি শুধরে নিই। মুখে মুখে তিন বার ‘তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করলে বা একসাথে ‘বায়েন তালাক’ শব্দটি উচ্চারণ করলে তালাক কার্যকরী হয় না। এমনকি, মুখে উচ্চারণ ব্যতিত লিখিতভাবে তালাক দিলেও তা সাথে সাথে কার্যকরী হয় না। এর মধ্যে রয়েছে সালিসী পরিষদের বিরাট ভূমিকা। সম্প্রতি  বিবাহবিচ্ছেদ, সন্তান হেফাজত ও দেনমোহরের মতো বিষয়ে জটিলতা এড়াতে সালিস পরিষদের (আরবিট্রেশন কাউন্সিল) কার্যকারিতা নিয়ে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। এ সংক্রান্ত এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে গত ১৫ এপ্রিল’২০১৯ বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহাসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রুল দেন।

 

রুলে পবিত্র কোরআন, আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও আইন অনুসারে বিবাহবিচ্ছেদ, দেনমোহর পরিশোধ ও সন্তানের হেফাজতের বিষয় নিষ্পত্তিতে এ-সংক্রান্ত সালিস পরিষদের ভূমিকা নিশ্চিতে একটি নীতিমালা করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ, ভরণ-পোষণসহ আনুষঙ্গিক পাওনা নিষ্পত্তিতে সালিসি পরিষদের ভূমিকা বাধ্যতামূলক করতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, রুলে তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছে।

 

এবার আসল কথায় আসি, ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনে বলা হয়েছে যে, তালাক যেভাবেই হোক না কেন, তালাক দিতে চাইলে যে কোন পদ্ধতির তালাক ঘোষণার পর অপর পক্ষ যে এলাকায় বসবাস করছেন সে এলাকার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান/পৌর মেয়র/সিটি কর্পোরেশন মেয়রকে লিখিতভাবে তালাকের নোটিশ দিতে হবে। সেই সাথে তালাক গ্রহীতাকে উক্ত নোটিশের নকল প্রদান করতে হবে।

 

চেয়ারম্যান/মেয়র নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ হতে নব্বই দিন অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো তালাক বলবৎ হবে না। কারন নোটিশ প্রাপ্তির ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান/মেয়র সংশ্লিষ্ট পক্ষদ্বয়ের মধ্যে আপোষ বা সমঝোতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে সালিশী পরিষদ গঠন করবে এবং উক্ত সালিশী পরিষদ এ জাতীয় সমঝোতার জন্য প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থাই অবলম্বন করবে। তবে সমঝোতার ৯০ দিন সময় চেয়ারম্যান কর্তৃক নোটিশ প্রাপ্তির তারিখ থেকে শুরু হয়। তালাক দেয়া বা নোটিশ লেখার তারিখ থেকে শুরু হয় না। (শফিকুল ইসলাম এবং অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র, ৪৬ ডি.এল.আর. পৃষ্ঠা ৭০০)।

 

সালিশি পরিষদ ৯০ দিন সময় পেয়ে থাকে।। এর মধ্যে প্রতি ৩০ দিনে একটি করে মোট তিনটি নোটিশ দেবে। এ সময় যদি স্বামী-স্ত্রী মনে করেন তাঁদের মধ্যে ভুল-বোঝাবুঝির কারণে তালাকের নোটিশ দেওয়া হয়েছে সে ক্ষেত্রে তাঁরা সমঝোতা করে তালাক প্রত্যাহার করে নিয়ে পুনরায় সংসার করতে পারেন। এ জন্য নতুন করে বিয়ের প্রয়োজন হবে না।

 

কিন্তু দুঃখের সাথে জানাতে হয় আমাদের দেশের অধিকাংশ সালিসী পরিষদ অনেক সময় ডাকে না এবং অনেকে যানও না। এমনকি এ আইন সম্পর্কে অবগতও নয়। এতে করে তালাক কার্যকর হয়ে যায়। তবে এর সঙ্গে দেনমোহর, ইদ্দতকালীন ভরণ-পোষণ ও সন্তান থাকলে তাদের জিম্মায় নেওয়ার বিষয়ও থাকে। যে কারণে তালাক কার্যকরের পরে এসব বিষয় নিয়ে মামলা হয়, যা নিষ্পত্তিতে অনেক সময় লেগে যায়। তাই পবিত্র কোরআনের মর্মবাণী, আন্তর্জাতিক কনভেনশন ও আইন অনুসারে সালিসি পরিষদ কার্যকর করতে এবং এ বিষয়ে একটি নীতিমালা তৈরির নির্দেশনা চেয়ে করা রিটটিতে আদালত ওই রুল দেন।

 

গত বছরের ২৭ আগস্ট ‘ঢাকায় ঘণ্টায় এক তালাক’ শিরোনামে প্রথম আলোতে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এটি যুক্ত করে বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পক্ষে সাধারণ সম্পাদিকা সীমা জহুর ও আইনজীবী কাজী মারুফুল আলম ওই রিটটি করেন, যার ওপর শুনানি শেষে আদালত ওই আদেশ দেন।

 

এবার আসা যাক তালাকপ্রাপ্তা স্ত্রীর ভরণপোষণ নিয়ে সালিসী পরিষদের ভূমিকা বিষয়ে। মো. হেফজুর রহমান বনাম ছামছুর নাহার বেগ এবং অন্যান্য (১৯৯৫) ১৫ বিএলডি. পৃষ্ঠা-৩৪ মামলায় হাইকোর্ট বিভাগের একটি সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, তালাক দেয়ার পরও তার তালাকপ্রাপ্ত উক্ত স্ত্রীর পুনঃবিবাহ না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য যৌক্তিক পরিমাণ অঙ্কের ভরণপোষণ দিতে বাধ্য। তবে এ প্রসঙ্গে আপিল বিভাগ ১৯ বিএলডি পৃষ্ঠা-২৭ মামলার সিদ্ধান্তে বলে যে, গর্ভাবস্থায় একজন তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীলোকের জন্য পরিষ্কার নির্দেশনা হলো তার সন্তান ভূমিষ্ঠ হওয়া পর্যন্ত সে ভরণপোষণ পাবে। আরেকটি মামলা রশিদ আহমেদ বনাম আনিছা খাতুন (১৯৩২) ৫৯ ইন্ডিয়ান আপিলস, পৃষ্ঠা ২১ এ বলছেন যে, ইদ্দতকাল শেষ না হওয়া পর্যন্ত যদি তালাকের বিষয় স্ত্রীকে অবহিত করা না হয় সেক্ষেত্রে তালাকের বিষয় অবহিত না হওয়া পর্যন্ত স্ত্রী ভরণপোষণ পেতে অধিকারিণী। এ বিষয়গুলোর সুরাহার দায়িত্ব সালিসী পরিষদের।

 

দেনমোহর বিষয়ে বলা আছে যে, স্ত্রী যদি স্বামীকে আগে তালাক দেন, সে ক্ষেত্রেও অর্থাৎ স্বামী বা স্ত্রী যিনিই তালাক দিন না কেন, দেনমোহরের টাকা অবশ্যই স্ত্রীকে দিতে হবে। তবে বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যৌন মিলন না হয়ে থাকলে কিংবা স্বামীর মৃত্যু হলে স্ত্রী অর্ধেক পরিমান দেনমোহর পেতে অধিকারিণী। (তাজবি বনাম নাতার শেরীফ, ১৯৪০, ২ এম.এল. জে. পৃষ্ঠা, ৩৪৫)। দেনমোহর দুই প্রকার। একটি তাৎক্ষণিক দেনমোহর, যা স্ত্রীর চাওয়ামাত্র পরিশোধ করতে হবে। আরেকটি হচ্ছে বিলম্বিত দেনমোহর। বিলম্বিত দেনমোহর বিবাহবিচ্ছেদ অথবা স্বামীর মৃত্যুর পর পরিশোধ করতে হয়। এ ছাড়া স্বামী সালিসি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করলে স্ত্রীকে বিলম্বিত দেনমোহর পরিশোধ করতে হবে।

 

বিচ্ছেদের পর সন্তানদের আইনগত অবস্থান কী হবে, তারা কার কাছে থাকবে, কে বহন করবে তাদের ভরণপোষণ- এ নিয়ে সালিসী পরিষদের এক বিরাট ভূমিকা রয়েছে।

 

মুসলিম আইন অনুযায়ী, পিতাই অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানের আইনগত অভিভাবক আর মা হচ্ছেন সন্তানের জিম্মাদার মাত্র। বিচ্ছেদ হলেও মা তাঁর সন্তানের তত্ত্বাবধান করার ক্ষমতা হারান না। ছেলের ক্ষেত্রে সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তানের বয়ঃসন্ধি বয়স পর্যন্ত মা সন্তানদের নিজের কাছে রাখতে পারবেন। সন্তানের মঙ্গলের জন্য যদি সন্তানকে মায়ের তত্ত্বাবধানে রাখার আরও প্রয়োজন হয়, সে ক্ষেত্রে এ বয়সসীমার পরও মা সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে পারবেন। তবে এ জন্য ক্ষেত্রবিশেষে আদালতের অনুমতির প্রয়োজন হতে পারে। তবে মা যদি দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তাহলে সন্তানকে নিজের হেফাজতে রাখার ক্ষমতা হারাতে হতে পারে।

 

আরেকটি বিষয় উল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, ১৬ ডিএলআর এ জোহরা বেগম বনাম মাইমুনা খাতুন মামলায় আদালত বলেন, নিষিদ্ধ স্তরের বাইরে মায়ের বিয়ে হলেই মায়ের কাছ থেকে হেফাজতের অধিকার চলে যাবে না। মা যদি তার নতুন সংসারে সন্তানকে হেফাজতে রাখতে পারেন, সেক্ষেত্রে তাকে সন্তানের জিম্মাদারি দিতে কোনো সমস্যা নেই।

 

তবে যদি আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয় যে, সন্তান মায়ের হেফাজতে থাকলে তার শারীরিক ও মানসিক বিকাশ স্বাভাবিক হবে, সন্তানের কল্যাণ হবে এবং স্বার্থ রক্ষা হবে- সেক্ষেত্রে আদালত মাকে ওই বয়সের পরেও সন্তানের জিম্মাদার নিয়োগ করতে পারেন। আবু বকর সিদ্দিকী বনাম এস এম এ বকর ৩৮ ডিএলআরের মামলায় এই নীতি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

 

বিচ্ছেদের পর সন্তান যদি মায়ের কাছেও থাকে, তবে সন্তানের ভরণপোষণের দায়িত্ব সম্পূর্ণ বাবার। অর্থাৎ মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হলে কিংবা মা-বাবা আলাদা বসবাস করলে বাবাকেই সন্তানদের ভরণপোষণ দিয়ে যেতে হবে। ইচ্ছে করলে মা আলাদা থেকেও বিবাহবিচ্ছেদ হোক বা না হোক, সন্তানের ভরণপোষণ আদায় করার জন্য নির্দিষ্ট সময়েরর মধ্যে পারিবারিক আদালতে মামলা দায়ের করে ভরণপোষণের অধিকার আদায় করতে পারেন।

 

প্রিয় পাঠক! আসুন আমরা একটি ইতিবাচক সংবাদের অপেক্ষায় থাকি। যেদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে পত্রিকার পাতায় দেখতে পাবো ‘তালাক ইস্যুতে সালিসী পরিষদের কার্যকারিতা সফলতা পেয়েছে।’ সেদিন আমাদের আইন, উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত ও সংবিধানের শ্বাসত বাণী চিরন্তন রুপ পাবে। শুরু হবে নতুন এক যুগের।

 

লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, গবেষক ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

 

 

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel