বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৩৮ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
ফটোক তোলাও শেষ, রিলিফ দেয়াও শেষ

ফটোক তোলাও শেষ, রিলিফ দেয়াও শেষ

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: আমার লেখার এ শিরোনামটি ৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যায় সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের ক্যামেরায় তোলা ছবির ক্যাপশন নিউজ। সাংবাদিকদের ডেকে কিছু দানশীল ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান বস্তিবাসীদের মধ্যে রিলিফ বিতরণের নামে ফটোসেসন দেখে তিনি এ শিরোনামটি করেছিলেন। দীর্ঘ বত্রিশ বছর পর করোনার প্রাদুর্ভাবে ত্রান দেয়ার নামে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ফটোসেসনের নামে আদিখ্যেপনা দেখে সাংবাদিক মোননাজাত ভাই বেঁচে থাকলে তিনি কি শিরোনামে নিউজ করতেন, তা আজ বোধগম্য নয়।

পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় বোয়ালিয়া ইউপি চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন বিশ্বাস সরকারি ত্রাণ বিতরণের সময় ছবি তুলতে না চাওয়ায় অসহায় নারী-পুরুষের সঙ্গে চরম অসদাচরণ করেছে। ওই চেয়ারম্যান ত্রাণ নিতে আসা অসহায় নারী-পুরুষকে মারধর করে ভিডিও ধারণ করতে বাধ্য করেছেন। গতকাল ১০ এপ্রিল সকালে ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয়ে দুস্থ নারী-পুরুষের মাঝে নিজ হাতে সরকারি বরাদ্দের ত্রাণ বিতরণের সংবাদ প্রচারের জন্য তিনি স্থানীয় কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মীকে আমন্ত্রণ জানান। এ সময় গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে দু’একজন ত্রাণ বিতরণের ভিডিও ধারণ করেন।

এবার একটি গল্প দিয়েই পাঠককে আমার নিবন্ধের গভীরে নিয়ে চাই। রাজার বাড়িতে এক প্রজা দাওয়াত পেলেন। প্রজা খুশি হয়ে তার ছেলেকে সাথে নিয়ে রওনা হলেন রাজার বাড়ির দিকে। যথারীতি পৌঁছালেন রাজপ্রাসাদে। নামাজের সময় হলে রাজার পাশে দাঁড়িয়ে তিনি নামাজ পড়লেন। তারপর ভোজসভা। রাজার পাশে বসে খেলেন। এবার ঘরে ফেরার পালা। ঘরে ফিরেই স্ত্রীকে ডেকে বললেন তিনি, কই গো! খাবার আনো, পেটের ক্ষুধা মেটেনি। সাথে থাকা ছেলেটি অবাক হয়ে বলে, ‘আব্বা! আপনি না রাজপ্রাসাদ থেকে এই মাত্র খেয়ে এলেন। আবার খাবেন?’ মুচকি হেসে তিনি বললেন, ‘বাবা, রাজার পাশে বসেছিলাম তো, তাই বেশি করে খাইনি, পাছে রাজা আবার পেটুক বলেন! সামান্য কয়েক লোকমা খেয়েছি, তাই আবার খাচ্ছি।’ ছেলেটি এবার মুখ খুলে বলে দিল, ‘তাহলে আব্বা, নামাজও আবার পড়ে নিন। রাজার পাশে নামাজও হয়তো আজ আপনি তাকে দেখানোর জন্য সুন্দর করে পড়েছেন, আল্লাহর জন্য নয়।’ এ কথায় চুপসে গেলেন তিনি।

শুধু তিনি না, দিনে রাতে আমরাও অহরহ মানুষকে দেখানোর জন্য কতো আমল করি! আমাদের সমাজে চারিদিকে আজ ‘সৌজন্যে’র ছড়াছড়ি। মসজিদ কিংবা মাদ্রাসার দেওয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়ির গায়েও অঙ্কিত থাকে, ‘এ ঘড়িটি দান করেছেন অমুক আলহাজ্ব!’ নিজেদের দান দক্ষিণা প্রচার করে দানবীর সাজার এ লড়াইয়ে সমাজপতিদের আগ্রহর কোনো কমতি নেই। সরকারী কর্মকর্তা তো বাদই দিলাম।

রাসুল (সা.) এর যুগে সাহাবায়ে কেরাম একদিন বসে আলোচনা করছিলেন। রাসুল (সা.) এসে জিজ্ঞেস করলেন, কী নিয়ে তোমরা কথা বলছিলে, তারা জানালেন, আমরা দাজ্জালের প্রকাশ ও বিপদ নিয়ে কথা বলছিলাম। রাসুল (সা.) বললেন, আমি তোমাদের জন্য দাজ্জালের চেয়েও কোন বিষয়টি নিয়ে বেশি আশঙ্কা করি জানো? তা হচ্ছে, পরোক্ষ শিরক। অর্থাৎ মানুষ তখন দু’রাকাত নামাজ এমন সুন্দরভাবে আদায় করবে যেন অন্যরা তাকে দেখে। (আহমদ, ইবনে মাজাহ)

লোক দেখানোর জন্য কোনো আমল করার নাম ‘রিয়া’। হাদীসের ভাষায় এ বিষয়টিকে ‘শিরকে খফী’ অর্থাৎ অপ্রকাশ্য শিরক বলা হয়েছে। মুসলমানের সব আমল তো একমাত্র আল্লাহর জন্য উৎসর্গিত হবে, এর নাম ইখলাস। ইখলাস ও রিয়ার অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত দুই মেরুতে।

কিয়ামতের মাঠে যে সাত ধরনের লোক আল্লাহ পাকের আরশতলে ছায়া পাবে, তাদের এক প্রকার এমন ব্যক্তি হবেন যে তারা এত গোপনে ডান হাতে দান করতেন যা তাদের বাম হাতও জানতো না।

প্রসিদ্ধ বুযুর্গ ও নবীর বংশধর যাইনুল আবিদীন বিন আলীকে মৃত্যুর পর যখন গোসল দেওয়া হচ্ছিল, তখন তাঁর পিঠে ও কাঁধে রশির দাগ দেখে সবাই অবাক হলেন। তাঁর স্ত্রীকে এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানালেন, রাতের অন্ধকারে তিনি নিজের পিঠে খেজুর, কিসমিস, আটা, ময়দা বহন করে একাকী বের হতেন আর বিভিন্ন ঘরের সামনে গিয়ে সেগুলো রেখে আসতেন। তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ওই পরিবারগুলোর কেউ জানতে পারেনি, কে প্রতি রাতে তাদের জন্য এসব খাবার রেখে যায়। যেদিন তাঁর ইন্তেকালের কারণে তা বন্ধ হয়ে গেল, সেদিন সবাই জানলেন, কে ছিল রাতের আগন্তুক।

পবিত্র কুরআনের সূরা নিসা ও সূরা মাঊনে দুই জায়গায় আল্লাহ ওই সব লোককে মন্দ বলেছেন, যারা লোক দেখানোর জন্য নামায আদায় করে। তাদের মুনাফিকও বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, একটি ক্ষুধার্ত বাঘকে ছাগলের পালের মধ্যে ছেড়ে দিলে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, মানুষের মালের লোভ ও সম্মানের আশা তার দ্বীন ও আমলে এর চেয়েও বেশি ক্ষতি সাধন করে। (তিরমিযী)

যারা এখানে সেখানে ওয়াজ করেন, বক্তব্য রাখেন- তাদের ব্যাপারে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মানুষের সামনে কোনো বয়ান করে বা বক্তব্য রাখে, আল্লাহ তাকে অবশ্যই জিজ্ঞেস করবেন, এ বয়ানের পেছনে তার কী উদ্দেশ্য ছিল? (বায়হাকী)

তিরমিযী শরীফের এক হাদীসে রাসুল (সা.) বলেছেন, যে কেউ আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি অর্জনের নিয়ত ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশে ইলম শিখে (আলেম মাওলানা হয়) সে যেন জাহান্নামে নিজের ঠিকানা বুঝে নেয়।

আরও ভয়ংকর বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘জুব্বুল হাযান’ নামে জাহান্নামের একটি উপত্যকা রয়েছে, স্বয়ং জাহান্নাম তার কাছ থেকে প্রতিদিন ১শ’ বার রক্ষা চায়। এ ভয়ঙ্কর উপত্যকাটি ওইসব কুরআন পাঠকদের জন্য, যারা লোক দেখানোর জন্য আমল করে। (তিরমিযী) সুতরাং সাধারণ মুসলমান কিংবা আলেম ওলামায়ে কেরাম, সবার জন্য এক চরম সতর্কবাণী উচ্চারিত হয়েছে এমন অসংখ্য হাদীসে।

সামান্য কোনো কাজও যদি মানুষের কাছে নিজের সম্মান ও মর্যাদা বাড়ানোর জন্য করা হয়, আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন সবার সামনে ঘোষণা করে তা প্রকাশ করে দেবেন। আর বলে দেবেন, যার জন্য আমল করেছিলে, তার কাছ থেকে এর প্রতিদান নিয়ে নাও। তাফসিরে ইবনে কাসীরে উল্লেখ রয়েছে, কেউ মানুষকে দেখানোর জন্য যতক্ষণ কোনো আমলে ব্যস্ত থাকলো, ততক্ষণ সে আল্লাহ পাকের অসন্তুষ্টির মধ্যে থাকলো। ইবনে মাজাহ শরীফের এক হাদীসে আল্লাহর রাসুল (সা.) বলেছেন, দুনিয়াতে যারা সুনাম সুখ্যাতির পোশাক গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়ায়, আল্লাহ পাক কিয়ামতের দিন তাকে অপমানের পোশাক পরিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেবেন। আমাদের মানসিক গতিপথ পরিবর্তনের জন্য এ কয়েকটি হাদীস যথেষ্ট।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

,

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel