মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ১১:৩৫ পূর্বাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
ঋণ আদায়ে ব্যাংকের চেক মামলায় নিষেধাজ্ঞা বনাম হাইকোর্টের মহানুভবতা!

ঋণ আদায়ে ব্যাংকের চেক মামলায় নিষেধাজ্ঞা বনাম হাইকোর্টের মহানুভবতা!

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
আগে গ্রামে মহাজনী প্রথা ছিলো। তারা গরীব জনসাধারণকে ঋণদান করতো কোন কিছু গচ্ছিত রেখে। বৃটিশ আমলে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছিল। একইভাবে পাকিস্তানে আমলে সুদূর আফগানিস্তান থেকে ঝোলা কাঁধে আসা কাবুলিওয়ালাদের সুদের টাকা খাটানো এবং তাদের অত্যাচার নিয়ে অসংখ্য কাহিনী প্রচলিত ছিল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশেও ব্যাংক নামক কাবুলিওয়ালাদের আগমন ঘটে। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর ধরে এসব সুদে প্রতিষ্ঠানের নানা অনিয়ম, অত্যাচার ও আইনবিরোধী কাজগুলোর মধ্যে একটি ছিল ঋণ দেয়ার সময় একগুচ্ছ অগ্রীম চেক রেখে দেয়া। সেই চেকের উপর ইচ্ছেমতো টাকা বসিয়ে চেক ডিজঅনারের মামলা করে গ্রাহককে জেল দেয়া আর জমি-জমা, ঘর বাড়ী বিক্রি করে টাকা আদায় করা।

এখন থেকে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ আদায়ের জন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনার মামলা করতে পারবে না বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান ঋণ আদায়ের জন্য শুধুমাত্র ২০০৩ সালের অর্থঋণ আইনের বর্ণিত উপায়ে অর্থঋণ আদালতে মামলা করতে পারবে। পাশাপাশি বর্তমানে আদালতে চলমান ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দায়ের করা সব চেক ডিজঅনার মামলার কার্যক্রম বন্ধ থাকবে বলে রায়ে বলা হয়েছে।

ঋণ আদায়ের জন্য এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্র্যাক ব্যাংকের চেক ডিজঅনার মামলা বাতিল করে বুধবার (২৩ নভেম্বর) বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। তবে হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ পক্ষ আপিল করতে পারেন।

রায়ে আদালত বলেছেন, ব্যাংক ঋণের বিপরীতে যে চেক নিচ্ছে সেটা জামানত। বিনিময়যোগ্য দলিল নয়। জামানত হিসেবে রাখা সেই চেক দিয়ে চেক ডিজঅনার মামলা করা যাবে না।

আদালত বলেন, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ একটি চুক্তির মাধ্যমে নেওয়া হয়ে থাকে। ব্যাংকের কিছু দুর্নীতিবাজ, অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের স্বার্থে, তাদের হিডেন এজেন্ডা বাস্তবায়নে চেকের অপব্যবহার করে মামলা করে থাকে। তাদের ব্যবহার দাদন ব্যবসায়ীদের মতো।

আদালত বলেন, ঋণের বিপরীতে ব্ল্যাংক চেক নেওয়াটাই বেআইনি। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দীর্ঘদিন ধরে এই বেআইনি কাজ করে আসছে।

রায়ে হাইকোর্ট নিম্নআদালতের প্রতি নির্দেশনা দিয়ে বলেন, আজ থেকে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি চেক ডিজঅনার মামলা করে তাহলে আদালত তা সরাসরি খারিজ করে দেবেন। একইসঙ্গে তাদেরকে ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে পাঠিয়ে দেবেন।

আদালত বলেন, ব্যাংক হওয়ার কথা ছিল গরিবের বন্ধু, কিন্তু তা না হয়ে ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গরিবের রক্ত চুষছে। এটা হতে পারে না। যারা হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে খেলাপি হচ্ছে ব্যাংক তাদের ঋণ মওকুফ করার কথা শুনি। কিন্তু কোনো গরিবের ঋণ মওফুফ করার কথা কোনোদিন শুনিনি। নীলকর চাষিদের মতো, দাদন ব্যবসায়ীদের মতো যেনতেন ঋণ আদায় করাই তাদের লক্ষ্য। লোন আদায়ের জন্য অর্থঋণ আইনে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান মামলা দায়ের না করে চেক ডিজঅনার মামলা করছে। এ কারণে আমাদের ক্রিমিনাল সিস্টেম প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে। তাই এখন থেকে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান শুধুমাত্র অর্থঋণ আদালতে মামলা দায়ের করতে পারবে। অন্যকোনো আইনে নয়।

ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি হাইকোর্টের রায়ের আলোকে নির্দেশনা জারি করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনরকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। এছাড়াও সব ধরনের ঋণের বিপরীতে ইনস্যুরেন্স কাভারেজ দিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত

ইসলামী অর্থব্যবস্থায় সুদ অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, ‘সুদ ভক্ষণকারীরা এমনভাবে (কবর থেকে) দাঁড়াবে যেন সে শয়তানের স্পর্শে উন্মাদ হয়েছে, কারণ তারা বলে বেড়ায় যে সুদ তো ব্যবসার মতো, অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে হারাম করেছেন।’ (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৭৫)।

তৎকালীন আরবে সুদের যেসব জায়গায় সবচেয়ে বেশি সুদি লেনদেন হতো তায়েফ ছিল তার অন্যতম। তায়েফের সাকিফ গোত্রের বনু আমর সুদের ভিত্তিতে বনু মাখজুমকে ঋণ দিত। ইসলাম গ্রহণের পর বনু আমর আগের সুদ দাবি করলে বনু মাখজুম তা দিতে অস্বীকৃতি জানায়। তখন মক্কার গভর্নর আততাব বিন উসাইদ (রা.)-এর কাছে বিচারের জন্য যায়। কিছুদিন পর তাঁর কাছে রাসুল (সা.) তাদের বিশাল অঙ্কের সুদ রহিত করে পত্রযোগে সুরা বাকারার ২৭৮ ও ২৭৯ নম্বর আয়াত লিখে পাঠান।

মূলত মদিনার ইহুদিরা পুরো আরবে ব্যবসা-বাণিজ্যে একচেটিয়া প্রভাবের মাধ্যমে সুদের বিস্তার করেছিল। তবে হিজরতের পর থেকে লেনদেনে সুদ ও শঠতার সুযোগ কমে যায়। সুদভিত্তিক লেনদেন তাদের জন্য নিষিদ্ধ হলেও তারা এতে জড়িত ছিল। পবিত্র কোরআনে তাদের মন্দ স্বভাব বর্ণনার সময় এটিও উল্লিখিত হয়েছে, ‘আর তারা সুদ নিত, অথচ তা তাদের জন্য নিষিদ্ধ, অন্যায়ভাবে মানুষের সম্পদ খেত, আমি কাফেরদের জন্য যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি প্রস্তুত করেছি। ’ (সুরা নিসা, আয়াত : ১৬১)

সামুরা বিন জুনদুব (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেছেন, এক রাতে দুজন লোক আমাকে পবিত্র ভূমিতে নিয়ে গেল। হাঁটতে হাঁটতে আমরা এক রক্তের নদীর তীরে আসি। নদীতে এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। নদীর কিনারে আরেক লোক দাঁড়ানো। তার চারপাশে পাথর। নদীতে থাকা লোকটি আসতে চাইলে কিনারের লোকটি তার মুখে পাথর নিক্ষেপ করে। লোকটি আবার আগের স্থানে চলে যায়। যতবারই লোকটি বের হতে চায় কিনারের লোকটি পাথর নিক্ষেপ করে। আর সে আগের স্থানে ফিরে যায়। আমি জিজ্ঞেস করলাম, এটা কে? সে বলল, নদীতে যাকে দেখছেন সে সুদখোর। ’(সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৩৩১)

জাবের (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুল (সা.) অভিসম্পাত করেছেন সুদখোর, সহযোগিতাকারী, সুদের লেখক ও সাক্ষ্যদাতাদ্বয়কে। আর তারা সবাই সমান পাপী। ’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩০৯৬)

লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, ইমেইলঃseraj.pramanik@gmail.com

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel