এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো ফেসবুক। কিন্তু কেউ বুঝে অথবা না বুঝে অপব্যবহার করছে ফেসবুক। ফলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ফেঁসে যাচ্ছেন তারা। এ আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী কেউ এ অপরাধে অভিযুক্ত হলে জামিন অযোগ্য ৩ বছরের কারাদন্ড, ৩ লক্ষ টাকা জরিমানাসহ উভয় দন্ড হতে পারে।
ইন্টারনেটে বিভিন্ন মাধ্যমের অপব্যবহার রোধে সরকার ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে। ফেসবুকে এ আইন অনুযায়ী যেসব কাজ দ-নীয়, তন্মধ্যে ১। ফেসবুকে মিথ্যা ও অশ্লীল এমন কোনো কিছু ব্যবহার করা যাবে না, যা কোনো ব্যক্তি পড়ে, দেখে ও শুনে নীতিভ্রষ্ট হতে পারে, ২। কোনো স্ট্যাট্যাস বা ট্যাগের কারণে কারো মানহানি ঘটে এমন কোনো কিছু করা যাবে না, ৩। এমন কোনো কিছু লেখা যাবে না যার মাধ্যমে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে, ৪। এমন কোনো লেখা ট্যাগ, শেয়ার করা যাবে না যার মাধ্যমে রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণœ হয়, ৫। ফেসবুকে এমন কোনো কিছু লেখা যাবে না যার মাধ্যমে কারো জাত, বর্ণ ও ধর্মীয় অনূভূতিতে আঘাত লাগতে পারে।
কোনো ব্যক্তি যদি ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট বা টুইটার আইডি তৈরি করে মূল ব্যবহারকারীকে বিব্রত বা হয়রানি করে এবং এতে ওই ব্যক্তি যদি আশঙ্কা করেন যে তিনি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পেশাগত ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারেন তাহলে তিনি (ভুক্তভোগী) থানায় জিডি করতে পারেন। সাধারণ ডায়েরি করা থাকলে, কারো নাম ব্যবহার করে কেউ যদি কোনো অপরাধ করে সে জন্য ভুক্তভোগী দায়ী থাকবেন না। যেহেতু তিনি আগেই থানায় জিডি করে রেখেছিলেন। আপনি যদি এ ধরনের সমস্যায় পড়েন এবং সমস্যা যদি বড় ধরনের কিছু হয় তাহলে আপনিও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করতে পারেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ধারা ২১ অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার বিরুদ্ধে প্রপাগান্ডা, প্রচারণা ও মদদ দিলে সর্ব্বোচ শাস্তি ১৪ বছরের কারাদ-; জরিমানা ৫০ লাখ টাকা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয়ভীতি দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে।
২৫ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখায়, তাহলে তাকে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানাসহ উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে।
ধারা ২৮ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করে এমন কিছু ডিজিটাল মাধ্যমে প্রচার করে, তাহলে সর্ব্বোচ ১০ বছরের সাজা। জরিমানা ২০ লাখ টাকা।
ধারা ২৯ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে পেনাল কোডের ৪৯৯ ভঙ্গ করে কোনো অপরাধ করেন তাহলে সর্ব্বোচ তিন বছরের কারাদ- ভোগ করবেন। জরিমানা পাঁচ লাখ টাকা।
৩০ ধারায় বলা হয়েছে, না জানিয়ে কেউ যদি কোনও ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংক-বীমায় ই-ট্রানজেকশন করে, তাহলে পাঁচ বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে।
৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের বিধান রাখা হয়েছে।
ধারা-৩২ অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করেন বা সহায়তা করেন, তাহলে সর্ব্বোচ ১৪ বছরের সাজা। ২৫ লাখ টাকা জরিমানা।
এ আইনে সাক্ষ্যগত মূল্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, সাক্ষ্য আইন বা অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এ আইনের অধীন প্রাপ্ত বা সংগৃহীত কোনো ফরেনসিক প্রমাণ বিচার কার্যক্রমে সাক্ষ্য হিসাবে গণ্য হইবে। কাজেই কোনো অপরাধী, ব্যক্তি বা সংগঠনের ফেসবুক, স্কাইপ, টুইটার বা ইন্টারনেটের যেকোনো মাধ্যমের অপরাধ-সংশ্লিষ্ট আলাপ-আলোচনা ও কথাবার্তা অথবা অপরাধ-সংশ্লিষ্ট স্থির ও ভিডিওচিত্র অপরাধের আলামত হিসেবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা আদালতে উপস্থাপন করতে পারবেন।
বাংলাদেশ বা বিশ্বের যেকোনো দেশে বসে বাংলাদেশের কোন নাগরিক যদি এই আইন লঙ্ঘন করেন, তাহলেই তার বিরুদ্ধে এই আইনে বিচার করা যাবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। অভিযোগ গঠনের ১৮০ কার্যদিবসের মধ্যে মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে।
মামলা করার নিয়মঃ-
১। আবেদনকারী এবং আসামীর নাম, ঠিকানা ও পরিচয় থাকতে হবে।
২। সাক্ষীর নাম, ঠিকানা ও পরিচয় থাকতে হবে।
৩। ঘটনা উদ্ভবের কারণ, ঘটনার স্থান, সময়, তারিখ থাকতে হবে।
৪। নালিশ বা দাবির ধরন, মূল্যমান থাকতে হবে।
৫। ক্ষতির পরিমাণ প্রার্থিত প্রতিকার থাকতে হবে।
৬। পক্ষদ্বয়ের সম্পর্ক উল্লেখ থাকতে হবে।
৭। সাক্ষীদের ভূমিকা থাকতে হবে।
৮। মামলা বিলম্বে দায়ের করা হলে তার কারণ উল্লেখ থাকতে হবে।
৯। আবেদনকারীর স্বাক্ষর থাকতে হবে।
১০। মামলা দায়েরের তারিখ থাকতে হবে।
১২। মামলাটি যেহেতু ডিজিটাল ডিভাইস সংক্রান্ত সেহেতু ঘটনটার প্রমানপত্র স্বরুপ ইউআরএল লিংক অবশ্যই সংরক্ষণ করে রাখতে হবে।
সংশ্লিষ্ট থানা মামলা না নিলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় সাইবার ট্রাইব্যুনাল মামলা করা যায়। প্রতিটি বিভাগে একটি করে সাইবার ট্রাইব্যুনাল রয়েছে।
৩২ ধারা মতে, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করেন বা সহায়তা করেন, তাহলে সর্ব্বোচ ১৪ বছরের সাজা। ২৫ লাখ টাকা জরিমানা।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে যাঁর বিরুদ্ধে লেখা বা আঁকা হচ্ছে, তাঁকেই মামলা করতে হবে এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সংক্ষুব্ধ যে কেউ মামলা করতে পারেন। সরকারের শীর্ষ পর্যায়, মন্ত্রী বা সাংসদের ‘মানহানি’তে মামলা করছেন আওয়ামী লীগ ও এর সহযোগী সংগঠনের নেতা, সাংসদ, মন্ত্রী বা সাংসদের পক্ষে তাঁদের বেতনভুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারী বা অনুগতরা। অভিযুক্তের তালিকায় রয়েছে সাংবাদিক, লেখক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কার্টুনিষ্ট, শিক্ষার্থী। এ আইনের মামলার ৪০ ধারা অনুসারে মামলার তদন্তের ক্ষেত্রে নির্ধারিত ৬০ দিন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তদন্ত কার্য সম্পন্ন করতে ব্যর্থ হলে তিনি তার নিয়ন্ত্রণকারী অফিসারের অনুমোদন সাপেক্ষে তদন্তের সময়সীমা অতিরিক্ত ১৫ দিন বৃদ্ধি করতে পারবেন।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮
সম্পাদক ও প্রকাশক : এ্যাডভোকেট পি. এম. সিরাজুল ইসলাম ( সিরাজ প্রামাণিক)
সম্পাদকীয় ও বাণিজ্যিক কার্যালয় :কুষ্টিয়া আদালত চত্ত্বর, খুলনা, বাংলাদেশ।
মোবাইল : 01716-856728, ই- মেইল : seraj.pramanik@gmail.com নিউজ: dainikinternational@gmail.com