বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৩ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
এক যৌনকর্মী ডাক্তারের কাছে গিয়ে বললেন তার শরীরে আরেকটি ছিদ্র করে দিতে। অবাক হয়ে ডাক্তার এর কারণ জিজ্ঞেস করতেই যৌনকর্মীটি চটপট জবাব দিলেন, ‘ইদানীং আমার ব্যবসা খুব ভালো যাচ্ছে। এক শাখায় খদ্দের সামলাতে পারছি না। তাই এখন আরেকটি শাখা খুলতে এসেছি!’ একজন যৌনকর্মীর সাথে একজন লোভী মানুষের পার্থক্য হচ্ছে টাকা পেলে যৌনকর্মীটি শুয়ে পড়েন আর পদের লোভ দেখালে লোভী মানুষটি বিবেক বিসর্জন দিয়ে দাঁড়িয়ে যান।
সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকীকে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক পদে নিয়োগ দিয়েছে সরকার। এই নিয়োগ নিয়ে কিছু প্রশ্ন ও অসংগতি সামনে আসায় নানা আলোচনা সমালোচনা চলছে। হয়তো এ আবেগ উত্তাপ আরও কিছুদিন চলবে খোদ পত্র-পত্রিকা, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া থেকে শুরু করে চায়ের দোকান পর্যন্ত। এর আগে বিসিএস তথ্য ক্যাডার ছেড়ে নন-ক্যাডারে সাবরেজিস্ট্রারে যোগদান কর্মকর্তার সংবাদটি নিশ্চয়ই আপনার দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
এবার মূল কথায় আসি। সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী এ পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে তিনি পদাধিকারবলে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান ছিলেন। এবার তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হলেন। উল্লেখ্য, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিউট আইন, ১৯৯৫ অনুযায়ী, এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হয় একটি পরিচালনা বোর্ড দ্বারা। আনুষ্ঠানিকভাবে চেয়ারম্যান এর শীর্ষ ব্যক্তি। কর্মরত প্রধান বিচারপতি পদাধিকারবলে এই বোর্ডের চেয়ারম্যান হন। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এখন এই বোর্ডের বর্তমান চেয়ারম্যান।
বর্তমান বাংলাদেশের জীবিত কবি হেলাল হাফিজের নাম আপনার নিশ্চয়ই শুনেছেন। যৌবনে তিনি মস্ত জুয়াড়ি ছিলেন, জীবনের একটা বড় অংশ তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন জুয়া খেলে। এখনও তিনি জুয়ার আসরে যান, নিজে এখন আর অংশ না নিলেও অন্যদের জুয়াখেলা তিনি বিরস বদনে দেখেন। ক্লান্ত-বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত-কপর্দকশূন্য-গতায়ু হেলাল হাফিজের এখন আর সাধ্য নেই জুয়ায় অংশ নেয়ার। একদিন এক ভক্ত তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হেলাল ভাই, এই বয়সে অন্যদের জুয়াখেলা দেখে আপনি কী মজাটা পান?’ তিনি বলেছিলেন, ‘সঙ্গমের আগে ফোর-প্লে করে যে মজাটা পাওয়া যায়, দূর থেকে অন্যদের জুয়াখেলা দেখে এখন আমি সেই মজাটা পাই!’
সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী যে প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান ছিলেন সেই পদের মর্যাদা ও গুরুত্ব বিবেচনায় রাখলে তাঁর জন্য বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হওয়া সম্মানজনক হবে কি-না তা পাঠকের উপর ছেড়ে দিলাম। কারণ এ পদে নিয়োগের ফলে হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী তাঁর পরবর্তী প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের অধীন কাজ করতে হবে। অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টে যিনি জ্যেষ্ঠ বিচারক ছিলেন, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে তিনি হবেন তাঁর অধস্তন কর্মকর্তা।
অতীত ইতিহাস থেকে জানা যায়, সাবেক প্রধান বিচারপতিদের অন্য কোনো পদে নিয়োগের দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। ব্যতিক্রম হলো আইন কমিশন। আইন কমিশন গঠনের পর থেকে সরকারের আস্থাভাজন বেশ কয়েকজন সাবেক প্রধান বিচারপতিকে সেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। যদিও এ সংস্থাটি কাগজেকলমে স্বাধীন এবং সেখানে চেয়ারম্যানই শীর্ষ পদ।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট আইন, ১৯৯৫ এর ১১(২) ধারায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই ধারা অনুযায়ী সরকার ‘যোগ্য’ কোনো ব্যক্তিকে বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিতে পারে। এই প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে আইনটির ১১(১ক) ধারায় বলা হয়েছে, ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারক বা বিচারক ছিলেন বা বিচারক হইবার যোগ্য কোন ব্যক্তি মহাপরিচালক হইবেন।’ ক্ষুদ্র জ্ঞানে যা বোঝা যায়, সেটা হচ্ছে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক এবং প্রধান বিচারপতি নিশ্চয়ই একই পদের নয়। এ দুটি পদ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এ দুটি পদের পদমর্যাদা, ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স এবং গুরুত্বও আলাদা। এসব বোঝার জন্য নিশ্চয়ই মহাপন্ডিত হওয়ার দরকার নেই।
আপনারা যারা বাংলা ব্যাকরণ পড়েছেন তার নিশ্চয়ই ‘পদ’ কাকে বলে পড়েছেন। যেটাকে ইংরেজিতে ‘পার্ট অব স্পিচ বলে’। এছাড়া পদ মানে পা। এই পদ দিয়ে আমরা হাঁটি। পাগলা কুকুর পেছনে লাগলে ঝেড়ে দৌড়ও দিই এই পদ দিয়ে। পদ দিয়ে আমরা ফুটবল খেলি। ফুটবলে লাথি আমরা দিই পদ দিয়েই।
কাজেই পদ হচ্ছে সেটাই, যা মানুষ আঁকড়ে ধরে রাখতে চায়। কোনোভাবেই নিচে নামতে চায় না। বরং চায় আরও ওপরে উঠতে। কিন্তু সাবেক প্রধান বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী পদ আঁকড়ে ধরে রাখতে এবার পদাবনতির শিকার হয়েছেন। শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা, আইনের শিক্ষক ও আইন গবেষক। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, ইমেইলঃseraj.pramanik@gmail.com