রবিবার, ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫১ অপরাহ্ন
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিকঃ
কুষ্টিয়া শহরের অদূরে একটি ছায়াঘেরা নিবিড় গ্রাম ছেঁউড়িয়া। এক পাশে শান্ত নদী গড়াই, অন্য পাশে কালিগঙ্গা। এখানেই বাউল স¤্রাট ফকির লালন শাহের সমাধি। ১৭ অক্টোবর তাঁর ১৩৪তম তিরোধান দিবস। ধামেই বসছে তিনদিনব্যাপী সাধু ভক্তদের লালমেলা। দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশ থেকেও আসছেন লালন ভক্তরা। লাখো ভক্তের হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসায় সিক্ত হয় লালন আখড়া।
একদিন ভোর বেলায় ষোল-সতের বছর বয়সের অচেতন অবস্থায় কিশোর লালন ভাসতে ভাসতে কালিগঙ্গা নদীর তীরে আসেন। ওই দিন ভোরবেলা মাওলানা মলম শাহ ফজরের নামাজ পড়ে কালিগঙ্গা নদীর দিকে সকালের মৃদু বাতাসে শরীর জুড়ানোর জন্য গিয়েছিলেন। হঠাৎই দেখতে পেলেন এক অচেনা সংজ্ঞাহীন কিশোর অর্ধজলমগ্ন অবস্থায় পড়ে আছে, ছেলেটির মুখে ও শরীরে বসন্ত রোগের দাগ। তিনি কাছে গিয়ে দেখলেন ছেলেটি বেঁচে আছে, খুব ধীরলয়ে চলছে শ্বাস-প্রশ্বাস। নিঃসন্তান হাফেজ মলমের বুকের ভেতর হু হু করে উঠল, এ কোনো অচেনা যুবক নয়; খোদা যেন তার সন্তানকেই ভাসিয়ে এনেছেন তার কাছে। মলম শাহ তখনই বাড়ি ফিরলেন এবং তার অপর তিন ভাইকে সঙ্গে নিয়ে এলেন। এবার চার ভাইয়ে ধরাধরি করে অচেনা যুবককে নিজের বাড়িতে আনলেন। মলম শাহ ও মতিজান দিনরাত সেবাযতœ করতে লাগলেন। দিন দিন অচেনা যুবকটির মুখে জীবনের আলো ফিরে এলো। মতিজান জিজ্ঞাসা করল, বাবা তোমার নাম কী? ফকির লালন।
আমৃত্যু ফকির লালন ছেঁউড়িয়াতেই ছিলেন, মৃত্যুর পর ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়িতেই তার সমাধি নির্মিত হয়। ছেঁউড়িয়াভিত্তিক লালনের জীবন-বৃত্তান্ত বিস্তারিতভাবে খুঁজে পাওয়া যায় ফকির আনোয়ার হোসেন মন্টু শাহ সম্পাদিত ‘লালন সংগীত’ নামক গ্রন্থে। লালন কোথায় ছিল, কীভাবে কালিগঙ্গা দিয়ে ভেসে এলো সব বিষয়ে যেসব তথ্য পাওয়া যায় তা সর্বজনগ্রাহ্য নয়। কথিত আছে, গঙ্গাস্নান সেরে ফেরার পথে লালন বসন্ত রোগে গুরুতরভাবে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। রোগের প্রকোপে অচেতন হয়ে পড়লে সঙ্গী-সাথীরা তাঁকে মৃত মনে করে রোগ সংক্রমণের ভয়ে তাড়াতাড়ি নদীতে ফেলে দেয়।
লালনের জন্মস্থান সম্পর্কে লালন গবেষক ড. আনোয়ারুল করিমের ধারণাটি ছিল অনবদ্য, ‘আমি দীর্ঘ ১০ বছর লালন ফকিরের জীবনী সংক্রান্ত বিষয়ে তথ্যানুসন্ধান করে বেড়িয়েছি। কিন্তু তার জাতিত্ব পরিচয় রহস্যাবৃত।’ আসলে লালন নিজেও তার জন্ম পরিচয় দিতে উৎসাহবোধ করেননি, তা তার গানেই স্পষ্ট
‘সব লোকে কয় লালন কি জাত সংসারে/ লালন কয় জাতের কি রূপ/ দেখলাম না এই নজরে।’ সত্যিই তাই, জাতপাতের ঊর্ধ্বে উঠে লালন নিজেকে শুধুই মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়ে গেছেন।
লালন হিন্দু কী মুসলমান, এ নিয়েও বিস্তর মতামত পাওয়া যায়। কারও মতে, লালন কায়স্থ পরিবারের সন্তান যার পিতা মাধব এবং মাতা পদ্মাবতী; পরে লালন ধর্মান্তরিত হন। গবেষকদের মতে, বেশিরভাগই মনে করেন লালন মুসলিম তন্তুবায়ী পরিবারের সন্তান। লালন ফকির নিজের জাত-পরিচয় দিয়ে গিয়ে বলেছেন ‘সব লোকে কয় লালন ফকির কোন জাতের ছেলে/কারে বা কী বলি আমি/দিশে না মেলে।’
রোগমুক্তির কিছুদিন পর লালন ফকির বিদায় চাইলেন, বললেন‘আমি সংসারত্যাগী মানুষ; এই ভবসংসারে আমার ঠাঁই নেই।’ কথিত আছে, লালন অলৌকিকভাবে হেঁটে ওই সময়কার প্রমত্তা কালিগঙ্গা পার হয়ে যান। পরে অবশ্য মলম ডিঙি নৌকা নিয়ে পার হয়ে প্রায় দৌড়ে গিয়ে লালনকে ধরে ফেলেন এবং ছেঁউড়িয়া ফিরে যাওয়ার জন্য ব্যথিত হৃদয়ে অনুরোধ করেন। লালন কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলেন, ‘যেতে পারি তবে আমার জন্য আলাদা জায়গার ব্যবস্থা করতে হবে।’ নিঃসন্তান মলম তার প্রিয় সন্তানের কথা রাখলেন। কালিগঙ্গা নদীর তীরে শ্যামল বৃক্ষম-িত মলমের বাগানে তৈরি হলো চৌচালা ঘর আর আখড়াবাড়ি। চৌচালা ঘরটি লালন সাধনকক্ষ হিসেবে ব্যবহার করতেন। কালের নিয়মে ছনের ঘরটি বিলীন হয়ে গেলেও মহান সাধক লালনের পরশমাখা সাধনকক্ষের কপাটজোড়া এবং জলচৌকি এখনও লালন একাডেমির জাদুঘরে রাখা আছে।
এই আখড়াবাড়িটিই ক্রমে লালন সাধনার পুণ্যধামে পরিণত হয়। ফজরের নামাজের পর মাওলানা মলম কোরআন তেলাওয়াত করতেন, ফকির লালন মনোযোগ দিয়ে তেলাওয়াত শুনতেন, মানে জিজ্ঞাসা করতেন। লালন কোরআনের কিছু কিছু আয়াতের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা করতেন, ব্যাখ্যা শুনে মাওলানা মলম অভিভূত হয়ে যেতেন।
লালন মুখে মুখেই গানের পদ রচনা করতেন। তার মনে নতুন গান উদয় হলে তিনি শিষ্যদের ডেকে বলতেন, ‘পোনা মাছের ঝাঁক এসেছে।’ লালন গেয়ে শোনাতেন, ফকির মানিক ও মনিরুদ্দিন শাহ সেই বাঁধা গান লিখে নিতেন। লালনের জীবদ্দশাতেই তার গান বহুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। ফকির মানিক শাহ সেই সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ গায়ক ছিলেন। লালনের শিষ্যদের ধারণা, তার গানের সংখ্যা দশ হাজারেরও বেশি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এত বিপুলসংখ্যক গান পাওয়া যায় না। শোনা যায়, লালনের কোনো কোনো শিষ্যের মৃত্যুর পর গানের খাতা তাদের কবরে পুঁতে দেয়া হয়। এছাড়াও অনেক ভক্ত গানের খাতা নিয়ে গিয়ে আর ফেরত দেননি।
ছেঁউড়িয়ায় কয়েক বছর থাকার পর লালন তার শিষ্যদের ডেকে বললেন, আমি কয়েক দিনের জন্য বাইরে যাচ্ছি, তোমরা আমার সাধনকক্ষটার দেখাশোনা করো। সপ্তাহ তিনেক পর তিনি একটি অল্পবয়স্কা সুশ্রী যুবতীকে নিয়ে ফিরলেন। মতিজান ফকিরানী জিজ্ঞাসা করলেন, মেয়েটা কে বাবা? জানান, তোমাদের গুরুমা। একথা শোনার পর আখড়াবাড়ির সবাই গুরুমাকে ভক্তি করলেন। বিশখা নামের এই মেয়েটি সারাজীবন লালনের সঙ্গে ছিলেন। লালনের মৃত্যুর ৩ মাস পর তিনি মারা যান। বিশখা ফকিরানী প্রায় একশ’ বছর ধরে ছেঁউড়িয়ায় ছিলেন, কিন্তু তার প্রকৃত নাম-পরিচয় জানা যায়নি। এমনকি মৃত্যুর পরও তার কোনো আত্মীয় বা পরিচিত জনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। অচিন মানুষ ফকির লালনের মতোই বিশখা ফকিরানী আজও এক অচিন নারী।
ফকির লালনকে নিয়ে বেশকিছু কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। একবার লালন তার শিষ্যদের নিয়ে গঙ্গা নদী পার হয়ে নবদ্বীপ গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর ধামে পৌঁছলেন। মন্দিরের লোকজন আগন্তুকদের বেশভূষা দেখে তাদের পরিচয় জিজ্ঞাসা করল। লালন শিষ্য শীতল শাহ বললেন, আমরা কুষ্টিয়া থেকে এসেছি, সবাই ফকির মতবাদের সাধক। তখন মহাপ্রভুর কাছে গিয়ে বলা হলো, কুষ্টিয়া থেকে কিছুসংখ্যক ফকির এসেছে যাদের বেশিরভাগ মুসলমান। মহাপ্রভু সব শুনে তাদের বসার ব্যবস্থা করতে বললেন। আঙ্গিনার এক পাশে বড় নিমগাছের তলায় তাদের জায়গা করে দেয়া হলো। সারা রাতের অনুষ্ঠান শেষে সাধুগুরু এবং বোষ্টমীদের সেবা দেয়ার পর যুবকরা পিতলের থালায় করে সোয়াসের চুন নিয়ে এলো এবং সবাইকে বলা হলো পাতুন, মহাপ্রভুর প্রসাদ গ্রহণ করুন। চুনে মুখ পুড়ে যাবে এই ভয়ে শিষ্যরা কেউ হাত পাতল না। বরং একযোগে ক্ষমা চাইল। যুবকরা বলল আপনারা কেমন সাধু! চুনে মুখ পুড়ে যাওয়ার ভয়ে কেউ হাত পাতলেন না। প্রকৃত সাধুদের তো মুখ পোড়ার কথা নয়! লালন এক কোনায় বসে ছিলেন, যুবকদের এই কথা শুনে বলল‘তামরা কী চাও?’ তোমরা কেমন সাধু হয়েছো তা দেখতে চাই।
লালন যুবকদের কলার পাতা এবং একটি চাড়ি আনতে বলল। অতঃপর তিনি খানিক চুন কলার পাতায় রেখে বাকি চুন চাড়িভর্তি পানিতে গুলিয়ে দিলেন। এবার তিনি নিজেই কলার পাতার চুনগুলো খেয়ে ফেললেন এবং শিষ্যদের চাড়ি থেকে গ্লাসে করে চুনগোলানো শরবত খাওয়ালেন। তারা সবাই শরবত পানের তৃপ্তি লাভ করল। এই শরবত পান চুন সেবা নামে পরিচিত। লালন ঘোড়ায় চড়তেন, মাঝে মাঝে গভীর রাতে চাঁদের আলোতে ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়াতেন, কোথায় নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন তা তার শিষ্যরা কেউ বলতে পারত না।
লালনের ভাবশিষ্যরা বিশ্বাস করে, শারীরিক প্রেম-ভালোবাসার মধ্যে প্রকৃত শান্তি নেই; প্রকৃত শান্তি আছে স্বর্গীয় ভালোবাসায়। গুরুর কাছে দীক্ষা গ্রহণের পর সাধনার বিশেষ স্তরে পৌঁছলেই কেবল শিষ্যকে খেলাফত প্রদান করা যায়। লালনের অনুসারীরা বিবাহ এবং স্ত্রী সম্ভোগ করতে পারে, কিন্তু তাদের বিশ্বাস, সন্তান উৎপাদনের ফলে আত্মা খ-িত হয় আর খ-িত আত্মা নিয়ে খোদার নৈকট্য লাভ করা যায় না। সেই কারণেই তারা সন্তান উৎপাদন থেকে বিরত থাকেন। তাছাড়া সন্তান উৎপাদনকে তারা বেদনাদায়ক বোঝা হিসেবেও বিবেচিত করেন।
বাকাবিল্লাহ ও ফানাফিল্লাহ অর্জন করার জন্য প্রয়োজন আত্মার পরিশুদ্ধতা। খেলাফত অর্জনের পর একজন সাধক সব পার্থিব বিষয় থেকে নির্মোহ হয়ে ওঠেন। পুরুষরা সাদা আলখেল্লা এবং সাদা লুঙ্গি পরে, অন্যদিকে মেয়েরা সাদা শাড়ি পরে, যাকে তারা বলে খিলকা।
লালন ফকিরের বয়স তখন ১১৬ বছর, একদিন তিনি শিষ্যদের ডেকে বললেন, এই আশ্বিন মাসের শেষের দিকে তোমরা কোথাও যেও না কারণ পহেলা কার্তিকে গজব হবে। গজবের বিষয়টি শিষ্যরা কেউ সঠিকভাবে অনুমান করতে না পারলেও আসন্ন বিপদের আশঙ্কা করতে লাগল। মৃত্যুর প্রায় এক মাস আগে তার পেটের ব্যারাম হয়, হাত-পায়ের গ্রন্থিতে পানি জমে। পীড়িতকালেও তিনি পরমেশ্বরের নাম সাধন করতেন, মধ্যে মধ্যে গানে উন্মত্ত হতেন। ধর্মের আলাপ পেলে নববলে বলীয়ান হয়ে রোগের যাতনা ভুলে যেতেন। এসময় দুধ ভিন্ন অন্য কিছু খেতেন না, তবে ইলিশ মাছ খেতে চাইলে শিষ্যরা বাজার থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে আসে। দুপুরে সাধন ঘরের সামনে সামিয়ানা টানিয়ে খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন করা হয়। বিকাল থেকে শুরু করে সারা রাত লালন তার শিষ্যদের শাশ্বত বাণী শোনা, মাঝে মাঝে গাওয়া হয় তার গান। রাতে আলোচনা শেষ করে লালন সাধন ঘরে ফিরে গেলেন বিশ্রাম নিতে। শিষ্যদের বললেন, আমি চললাম। লালন চাদর মুড়ি দিয়ে বিশ্রাম নিলেন, শিষ্যরা মেঝেতে বসে থাকলেন। এক সময় লালন কপালের চাদর সরিয়ে বললেন, তোমাদের আমি শেষ গান শোনাব। লালন গান ধরলেন, গভীর অপরূপ সুন্দর গান‘পার কর হে দয়াল চাঁদ আমারে/ক্ষম হে অপরাধ আমার/এই ভব কারাগারে।’
গান শেষ হলো, চাদর মুড়ি দিয়ে চিরদিনের জন্য নীরব হয়ে গেলেন ফকির লালন। ফকির লালনের জন্ম সাল জানা যায়নি, তিনি ১ কার্তিক ১২৯৭ বঙ্গাব্দ মোতাবেক ১৭ অক্টোবর ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দে মারা যান এবং তিনি বেঁচে ছিলেন ১১৬ বছর। সে হিসেবে তিনি জন্মেছিলেন ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে। ছেঁউড়িয়াতে ফকির লালনের সঙ্গে তার পালিত মা মতিজান ফকিরানী, পালিত বাবা মলম শাহ, ফকির ম-িত মানিক শাহ, শীতল শাহ, ভোলাই শাহ, বিশখা ফকিরানী এবং ফকির মনিরুদ্দিন শাহসহ অন্য আরও অনেক ভাবশিষ্যের সমাধি আছে।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও সাঁইজির ধামের প্রতিবেশী। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, ইমেইলঃseraj.pramanik@gmail.com