শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১২:৩২ অপরাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
সংবাদ শিরোনাম :
বিচার চেয়ে মান-ইজ্জত নিয়ে টানাহেঁচড়া বনাম আমাদের আইন-আদালত

বিচার চেয়ে মান-ইজ্জত নিয়ে টানাহেঁচড়া বনাম আমাদের আইন-আদালত

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক: আমাদের প্রচলিত আইনানুযায়ী দাম্পত্য সম্পর্ক হলেই নারী তার পূর্ণ দেনমোহরের টাকা পাবেন, নয়তো পাবেন অর্ধেক। দাম্পত্য সম্পর্ক হয়েছে কি হয়নি এটা প্রমাণ করতে গিয়েই নারীকে প্রতিনিয়ত সম্ভ্রম হারাতে হচ্ছে। মান-ইজ্জত নিয়ে ‘টানাহেঁচড়া’ দেখে অনেকেই বিচার চাইতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যায়। সওয়াল-জবাবের নামে আইনজীবীর ‘আপত্তিকর জেরা’ এড়াতে অনেক নারী আদালতের দ্বারস্থ হতে চায় না। এ কারণে অধিকার বঞ্চিত নারী ও তাঁর পরিবার মামলা করতে নিরুৎসাহিত হন ও ন্যায়বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হন। কারণ খোদ সাক্ষ্য আইনের ১৫৫ (৪) ধারাই যেখানে বিচারপ্রার্থী নারীকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে উপস্থাপনের লাগামহীন সনদ দিয়ে দিচ্ছে সেখানে ওই নারীকে অপমানিত হওয়া থেকে আদালত কোনভাবেই রক্ষা করতে পারছে না। এই ধারাটি ব্যাপকভাবে নারী অধিকার সংশ্লিষ্ট মামলাগুলোকে প্রভাবিত করে চলেছে। এমনকি অপরাধী তার অপরাধ স্বীকার করার পর এই ধারাটির কাঁধে ভর করে বেকসুর খালাস পাওয়ার উদাহরণও রয়েছে যথেষ্ট।

সুন্নি আইন অনুযায়ী বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা শেষে স্বামী-স্ত্রী একসঙ্গে রাতযাপন (বাসর) করলেই তাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতের একাধিক সিদ্ধান্ত রয়েছে যেমন মমতাজ বেগম বনাম আনোয়ার হোসাইন ১৭ বি এল সি (এ ডি) ইত্যাদি।

যদি কোনো স্ত্রী স্বামীর কাছে নির্ধারিত দেনমোহর চেয়ে না পায়, তবে সেই স্ত্রী স্বামীর সাথে বসবাস করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে (মাহমুদা খাতুন বনাম আবু সাইদ ২১ ডিএলআর)। এমনকি সে দূরে বসবাস করতে পারে। (১১ ডিএলআর, ১২৪)

তবে আজকের আলোচ্য বিষয় হাসিনা খাতুনের দেনমোহর আদায়ের মামলা। মামলার বাদিনী হাসিনা খাতুন তার বিয়ের প্রায় দুই বছর পর দেনমোহর চেয়ে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। যার মধ্যে প্রায় দেড় বছর তার স্বামীর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ এবং যাতায়াত অব্যাহত ছিল। মোজাহেদুল ইসলাম বনাম রওশন আরা (২২ ডি.এল.আর, পৃষ্ঠা-৬৭৭) মামলায় বলা হয়েছে, দেনমোহর কখনই মাফ হয় না। স্বামী যদি মারাও যায় তবে সে স্বামীর সম্পদ হতে দেনমোহর আদায় করা যায়। অর্থাৎ স্বামীর মৃত্যুর পর যদি স্ত্রী সমুদয় অথবা শুধুমাত্র বিলম্বিত দেনমোহরের অর্থ অনাদায়ী থেকে থাকে। তবে স্ত্রী তার প্রয়াত স্বামীর ভূ-সম্পত্তি দখল করে রাজস্ব বা মুনাফা হতে তা উসুল করতে পারে। কেননা ইসলামী আইনে দেনমোহরকে দেনা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। দেনমোহরের পরিমাণ যত বেশি হোক না কেন, পক্ষগুলোর মধ্যে স্বীকৃত হলে স্বামী তা সম্পূর্ণ রূপে স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য থাকবে। এমনকি স্বামীর আর্থিক সঙ্গতি না থাকলেও আদালত দেনমোহরানার দায় হতে স্বামীকে মুক্তি দেবে না।

আইনে একজন নারীর দেনমোহর পাওয়ার পক্ষে এত আইন থাকলেও বিবাদীপক্ষের আপত্তিতে বিচারক ক্যামেরা ট্রায়ালের অনুমতি দেন যেখানে বাদিনী হাসিনা খাতুনকে খুবই ব্যক্তিগত এবং আপত্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখী হতে হয়। মামলার জেরাতে বিবাদী পক্ষের আইনজীবীর যেসব আপত্তিকর প্রশ্নে হাসিনা খাতুন জর্জরিত হয়ে পড়ে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-১. প্রথম দৈহিক মিলন কবে হয়েছিল? ২. আপনার স্বামীর লিঙ্গ কতটুকু? ৩. লিঙ্গ ছোট না বড়? ৪. লিঙ্গ মোটা না চিকন? ৫. বীর্য কি পাতলা না ঘন? ৬. স্বামী দৈহিক মিলনে সক্ষম ছিল কি-না? ৭. স্বামীর গোপনাঙ্গে কোনো চিহ্ন দেখেছেন কি-না? ৮. দেখলে কী চিহ্ন? ৯. সুনির্দিষ্ট করে লিঙ্গের চিহ্নের স্থানের নাম বলুন ইত্যাদি।

নারীর সম্ভ্রম রক্ষার্থে এত আইন তৈরী হলেও বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা নারীর সম্ভ্রম রক্ষা করতে রীতিরকম ব্যর্থ হচ্ছে। বিচার চাইতে এসে নারীকে প্রতিনিয়ত চোখের জল ফেলতে হচ্ছে, অপমানিত হতে হচ্ছে প্রতি পদে পদে। হাসিনা খাতুনকেও চোখের জল ফেলতে হয়েছে দেনমোহর ও ভরণপোষণের টাকা চাইতে এসে। অথচ দেনমোহর স্বামীর ঋণ, যা স্বামী তাঁর স্ত্রীকে পরিশোধ করতে বাধ্য। মাহমুদা খাতুন বনাম আবু সাইদ (২১ ডি.এল.আর) মামলায় মহামান্য বিচারপতি কর্তৃক সিদ্ধান্তে বলা হয়েছে যে, ‘সহবাসের আগে এবং পরে স্ত্রী স্বামীর কাছে তলবী মোহরানার দাবি করতে পারে এবং স্বামী তলবী দেনমোহর পরিশোধ না করলে স্ত্রী তার স্বামীর অধিকারে অর্থাৎ সহবাসে যেতে স্ত্রী অস্বীকার করতে পারেন।’

যাহোক, প্রমাণের স্বার্থে বিপক্ষের বিজ্ঞ কৌঁসুলি উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর অবতারণা করতেই পারেন। কিন্তু পুরুষ বিচারক ও পুরুষ আইনজীবীর সামনে উপরিউক্ত প্রশ্নের উত্তর দিতে যে কোনো নারীর অশ্রু ঝরবে, তার সম্ভ্রমে আঘাত লাগবে এটাই স্বাভাবিক। সম্ভ্রম হারানোর ভয়ে এ ধরনের মামলায় অনেক নারীই অনাগ্রহ প্রকাশ করেন। অবশেষে ছেড়ে দিতে হয় তার গুরুত্বপূর্ণ একটি অধিকার।

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com, মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel