বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪, ০৫:৪৭ অপরাহ্ন

ঘোষনা :
  সম্পূর্ণ আইন বিষয়ক  দেশের প্রথম দৈনিক পত্রিকা   দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল এর  পক্ষ থেকে সবাইকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা   । 
দাদার আগে বাবার মৃত্যুতে নাতীদের অংশ বনাম বাস্তবতা!

দাদার আগে বাবার মৃত্যুতে নাতীদের অংশ বনাম বাস্তবতা!

 

এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
দাদার আগে আপনার বাবার মৃত্যু হলে দাদার সম্পত্তিতে আপনার অংশ প্রাপ্তি, আমাদের প্রচলিত আইন এবং কোরআন কি বলে-সে বিষয়ে আজকের আলোচনা। আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনের মধ্যে ওয়ারিশদের প্রত্যেকের অংশ নির্ধারণ করে দিয়েছেন, অতঃপর সতর্ক করে দিয়েছেন যে এই বণ্টন অনুসরণ না করলে আল্লাহর দেওয়া সীমা লঙ্ঘনের ফলে কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন: ‘আল্লাহ তোমাদের অংশ সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করলেন যেন তোমরা এ ব্যাপারে ভ্রষ্টতার শিকার না হও। আল্লাহ সব বিষয়ে অবগত।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ১৭৬)।

আমাদের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সমস্ত দরকারি জ্ঞানের অর্ধেকই হচ্ছে উত্তরাধিকার সংক্রান্ত জ্ঞান।’ দাদার সম্পত্তিতে এতিমের অধিকারের বিষয়টি নিয়ে একটি উদাহরণ দিলেই বিষয়টি আপনাদের মাঝে আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে। রহিম সাহেব জীবিত থাকাবস্থায় তাঁর ছেলে করিম সাহেব মারা যায়। মৃত করিম সাহেবের একটি পুত্রসন্তান আছে। তার নাম আরিফ মিয়া। এখন দাদা রহিম সাহেব মারা গেলে তাঁর সম্পত্তিতে তাঁর নাতি আরিফ মিয়ার কোনো অংশ বা ভাগ পাবে কি না তা নিয়ে নানা প্রশ্ন এবং বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। আরিফ মিয়ার চাচারা তাকে তার দাদার সম্পত্তিতে প্রাপ্য পিতার অংশ থেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছে।

এই ঘটনার সমস্যা সমাধান হিসেবে বলা যায় যে, যদিও মুসলিম শরিয়া আইন অনুযায়ী দাদার আগে বাবা মারা গেলে সন্তানরা কোনো অংশ পাওয়ার অধিকারী হন না; কিন্তু মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ-১৯৬১ সালের ৪ ধারা অনুসারে দাদা জীবিত থাকাবস্থায় বাবা মারা গেলেও মৃত ব্যক্তির সন্তানরা দাদার মৃত্যুর পর দাদার সম্পত্তিতে অংশীদার হবে। সন্তানদের বাবা জীবিত থাকাবস্থায় যেটুকু সম্পত্তি পেতেন, সমপরিমাণ সম্পত্তি সন্তানরা পাবেন। এ ক্ষেত্রে ছেলে বা কন্যাসন্তানের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের বৈষম্য হবে না।

আরেকটি উদাহরণ দিলে আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে। জামাল সাহেবের ছয় ছেলে ও এক মেয়ে। মেয়ের নাম রহিমা বেগম। কিন্তু দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে রহিমা বেগম তাঁর একমাত্র কন্যাসন্তান নোমেসা বেগমকে রেখে মারা যান। তার বেশ কয়েক বছর পর মারা যান জামাল সাহেব। অর্থাৎ রহিমা বেগম মারা যান ১৯৫৫ সালে এবং তাঁর বাবা জামাল সাহেব মারা যান ১৯৮৪ সালে। জামাল সাহেব মৃত্যুর সময় ছয় ছেলে ও এক স্ত্রী রেখে মারা যান। তবে তাঁর মৃত্যুর সময় তাঁর নাতনি নোমেসা বেগম জীবিত ছিল। এখন জামাল সাহেবের সম্পত্তি ভাগের সময় নোমেসা বেগম (নাতনি) সম্পত্তির অংশ দাবি করলে তাঁর ছয় ছেলে ও বিধবা স্ত্রী ঘোর আপত্তি জানিয়ে বলে যে, নোমেসা বেগমের মা রহিমা বেগম মারা যান ১৯৬১ সালের আগে; অর্থাৎ আরো সুস্পষ্টভাবে বলা যায়, মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ-১৯৬১ সালের এ আইনটি কার্যকর হওয়ার অনেক আগে। সুতরাং তাঁর মেয়ে নোমেসা বেগম তার নানা জামাল সাহেবের রেখে যাওয়া সম্পত্তিতে অংশীদার হতে পারবেন না। এই ছিল তাঁদের আপত্তির মূল ভিত্তি।

এ জাতীয় সমস্যা সমধানের জন্য এগিয়ে এসেছেন মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। শেখ ইব্রাহীম ও অন্যান্য বনাম নাজমা বেগম, ৪৪ ডিএলআর (এডি), ২৭৬ পৃষ্ঠায়) এই মামলায় বলেছেন যে ‘মৃত ব্যক্তির কন্যাসন্তান ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ কার্যকর হওয়ার আগে না পরে মারা গেছেন, তা এখানে গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং সাকসেশন কবে ওপেন হয়েছে, সেটাই মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ।’ সুতরাং জামাল সাহেব মারা গেছেন ১৯৮৪ সালে; অর্থাৎ ১৯৬১ সালের আইন কার্যকর হওয়ার পরে এবং সাকসেশন ওপেন হয়েছে তাঁর মৃত্যুর তারিখ থেকে। তাই নোমেসাা বেগম (তাঁর নাতনি) অবশ্যই তাঁর মা রহিমা বেগম বেঁচে থাকলে যতটুকু সম্পত্তি পেতেন, সেই সমপরিমাণ সম্পত্তি তিনিও পাবেন।

ইসলামী আইন বনাম ‘মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১’ বিষয়ে আলোচনা করলে দেখা যায় যে, আইনটি মুসলিম নামধারী পাকিস্তানি শাসক আইয়ুব খান ‘মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১’তে চালু করেছিলেন। তা হলো, দাদার জীবদ্দশায় পিতা মারা গেলে চাচাদের উপস্থিতিতে নাতি-নাতনিরা দাদার মিরাস পাবে কি না? এ আইনটির ৪ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে ‘যার সম্পত্তি উত্তরাধিকার সূত্রে বণ্টিত হবে, তার পূর্বে তার কোনো পুত্র বা কন্যা মারা গেলে এবং উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি বণ্টনের সময় উক্ত পুত্র বা কন্যার কোনো সন্তানাদি থাকলে, তারা প্রতিনিধিত্বের হারে সম্পত্তির ওই অংশ পাবে, যা তাদের পিতা অথবা মাতা জীবিত থাকলে পেত।’ ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের এ ধারাটি সম্পূর্ণ শরিয়তবিরোধী আইন। কোরআন-হাদিস ও ইজমায়ে সাহাবার সিদ্ধান্তকে উপেক্ষা করে আইয়ুব খানের শাসনামলে তা প্রস্তুত করা হয়। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, স্বাধীন বাংলাদেশে আইয়ুব খানের ওই পরিত্যক্ত আইন স্থান করে নিয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান নাগরিকের ওপর মুসলিম আইনের নামে সম্পূর্ণ কোরআন-হাদিসবিরোধী আইন চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। শরিয়তের বিধান হলো, দাদার জীবদ্দশায় পিতা মারা গেলে চাচাদের উপস্থিতিতে নাতি-নাতনিরা দাদার মিরাস পাবে না।

লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও আইন গবেষক। Email: seraj.pramanik@gmail.com,  মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮

এই সংবাদ টি সবার সাথে শেয়ার করুন




দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল.কম’র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।  © All rights reserved © 2018 dainikinternational.com
Design & Developed BY Anamul Rasel