
এডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
থানা কিংবা আদালতে কোনো মামলা করা হলে তার বিষয়বস্তু সাক্ষ্য দ্বারা আদালতে প্রমাণ করতে হয়। কিন্তু সেই মামলাটি প্রমাণের জন্য কত জন সাক্ষী প্রয়োজন? প্রশ্নটি প্রায়ই বিচারপ্রার্থীদের মনে দেখা দেয়। কেউ ভাবেন বেশি সাক্ষী মানেই মামলা জেতার সম্ভাবনা বেশি, আবার কেউ মনে করেন, অল্প সাক্ষী থাকলেও সত্য ঘটনা তুলে ধরা গেলেই যথেষ্ট। কাজেই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে শুধু আদালতের শরণাপন্ন হওয়াই যথেষ্ট নয়, যথাযথ সাক্ষ্যও সেখানে পেশ করতে হয়।
সাক্ষ্য আইন ১৮৭২-এর ১০১ ধারা অনুযায়ী, মামলা প্রমাণ করার দায়িত্ব সর্বদা বাদীপক্ষের ওপর থাকবে। অর্থাৎ বিবাদীর প্রতি আনা অভিযোগ বাদীকেই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে। আইনের ভাষ্য, অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দোষ বলে ধরে নিতে হবে
সাক্ষ্য আইনের ১০২ ধারার বিধান অনুযায়ী, মামলা যখন এমন পর্যায়ে থাকে যে কোনো পক্ষ সাক্ষ্য উপস্থাপন না করলে সেই পক্ষ পরাজিত হবে, তখন যে পক্ষের পরাজিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে, তাকে সাক্ষ্যপ্রমাণ দিতে হবে। হাসমত আলী বনাম রাষ্ট্র ৫৩ বিএলডি (এইচসি)১৬৮ মামলায় স্ত্রীর মৃত্যুর জন্য তাঁর স্বামীকে আসামি করা হয়। এখানে আদালত অভিমত প্রকাশ করেন, স্ত্রীর মৃত্যুকালে আসামি যে বাড়িতে ছিলেন না, তা আসামিকে প্রমাণ করতে হবে। এভাবেই প্রমাণ দাখিলের ভার এক পক্ষ থেকে অন্য পক্ষে পরিবর্তন হয়।
আবার কেউ ভাবেন বেশি সাক্ষী মানেই মামলা জেতার সম্ভাবনা বেশি, আবার কেউ মনে করেন, অল্প সাক্ষী থাকলেও সত্য ঘটনা তুলে ধরা গেলেই যথেষ্ট। বিষয়টি স্পষ্ট করেছে সাক্ষ্য আইনের ১৩৪ ধারা। যেখানে বলা হয়েছে: “সাক্ষীর সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়”। অর্থাৎ, একটি মামলা প্রমাণ করতে একটি সাক্ষ্যই যথেষ্ট হতে পারে, যদি তা নিভর্রযোগ্য ও প্রাসঙ্গিক হয়। আপিল বিভাগের একটি সিদ্ধান্ত ৪৩ বিএলডি পেজ নম্বর ৯৫ বলছে, একজন সাক্ষীকে বিশ্বাস করে বিজ্ঞ বিচারক সাজা প্রদান করতে পারেন। পর্যবেক্ষণ বলছে সাক্ষীর সংখ্যা নয়, বরং সাক্ষীর সত্যতা, পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা এবং আদালতে বক্তব্যে অটল থাকার ক্ষমতাই আসল।
একজন সাক্ষী যদি মামলার মূল ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হন এবং আদালতের কঠিন জেরার মুখেও সত্য কথা থেকে না সরেন, তবে সেই একজনই পুরো মামলার রায় ঘুরিয়ে দিতে পারেন। অনেক মামলায় দেখা গেছে একজন মাত্র সাক্ষী দিয়েই বাদী তার দাবির স্বপক্ষে রায় পেয়েছেন। আবার কখনো অনেক সাক্ষী উপস্থাপন করেও বাদী পক্ষ মামলা হারিয়েছেন, কারণ তাদের সাক্ষ্য ছিল অসামঞ্জস্যপূর্ণ বা বিভ্রান্তিকর।
একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিস্কার হয়ে উঠবে “একটি জমি সংক্রান্ত মামলায় এক ‘নামাজি ধার্মিক’ ব্যক্তিকে সাক্ষী করা হয় যিনি এলাকাবাসীর কাছে বিশ্বস্ত। কিন্তু জেরা চলাকালীন তিনি এমন কিছু সত্য কথা বলেন যা মামলার বাদীর অনুকূলে যায়নি। কারণ, বাদী পক্ষ তাকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করেনি। ফলে মামলা দুর্বল হয়ে পড়ে।” শুধু বিশ্বস্ত বা ঘনিষ্ঠ লোকজনকে বা আত্মীয়-স্বজনকে সাক্ষী হিসেবে আদালতে নিয়ে আসা যথেষ্ট নয়।
সাক্ষীকে মামলার বিষয়বস্তু সম্পর্কে ভালোভাবে জানাতে হয় এবং এমন কাউকেই বেছে নিতে হয় যিনি উকিলের জেরা সহ্য করে সত্য কথায় অটল থাকতে পারেন। “আপনার আইনজীবী যতই বলুক দুই তিনজন সাক্ষী নিয়ে আসুন আপনাকে বুঝতে হবে কে সত্যিকার অর্থে সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী এবং কে আদালতে গিয়ে সত্য কথা বলার মানসিক দৃঢ়তা রাখে। নইলে সাক্ষী যেমন দুর্বল হবে, তেমনি আপনার মামলাও দুর্বল হয়ে পড়বে।”
তাই আদালতে মামলার সাফল্য নির্ভর করে গুণগত সাক্ষ্যদানে, সংখ্যায় নয়। সত্যজ্ঞানসম্পন্ন, সাহসী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ সাক্ষীই যে কোনো পক্ষের জন্য বড় সম্পদ হয়ে উঠতে পারেন।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও পিএইচ. ডি ফেলো। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, ইমেইলঃseraj.pramanik@gmail.com