
এডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
শিরোনাম দেখে আমাকে সাম্প্রদায়িক ভেবে গালিগালাজ করবেন না। আমি ধর্ম-কর্ম অত বুঝি না। তবে আইনের ছাত্র হিসেবে আইন-কানুন কিছু বুঝি। আইনের আলোকেই বুক চাপড়ানো সনাতন বন্ধুদের মায়াকান্না আর ভারতীয় মিডিয়ার মিথ্যাচারের বিরুদ্ধেই আমার এ লেখা।
পাঠক আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০১৮ আওয়ামী সরকারের শাসনামালে শুধু সৌন্দর্য্য বর্ধনের নামে হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্পে ৫টি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা ভেঙে ফেলা হয়েছিল। রাষ্ট্র বা সরকার দেশের উন্নয়ন কর্মকান্ড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অবকাঠামো নির্মাণে এ কাজের অধিকারী। তবে স্থাবর সম্পত্তি অধিগ্রহণ ও হুকুম দখল আইন, ২০১৭ ধারা (১৩) অনুসারে ধর্মীয় উপাসনালয়, কবরস্থান ও শ্মশান অধিগ্রহণ করা যাবে না। তবে শর্ত আছে যে, এগুলোও অধিগ্রহণ করা যাবে যদি তা জনস্বার্থে একান্ত অপরিহার্য হয়। সেক্ষেত্রে স্থানান্তর ও পুনঃনির্মাণ করে দিতে হবে।
হাতিরঝিল উন্নয়ন প্রকল্পে ৫টি মসজিদ ও একটি মাদ্রাসা আজও স্থানান্তর ও পুনঃনির্মাণ করা হয়নি।
তখন কেউ শ্লোগান দেয়নি, সহিংসতায় যায়নি। মুসলমানরা বুঝেছিল এটা ধর্মীয় বিদ্বেষ নয়, বরং রাষ্ট্রের উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশ। এটাই সচেতন নাগরিকত্বের নমুনা।
ভারতে মসজিদ ভাঙার ঘটনা এবং সমীক্ষা একটি চলমান বিতর্কিত বিষয়। বাবরি মসজিদ, যা ১৫ শতাব্দীর একটি মসজিদ ছিল, ১৯৯২ সালে হিন্দু জনতা কর্তৃক ভেঙে ফেলা হয়।
যে দুর্গা মন্দিরটি বৃহস্পতিবার ভাঙা হয়েছে সেটি রেলের জমি অবৈধভাবে দখল করে কর্তৃপক্ষের বিনা অনুমতিতে অস্থায়ীভাবে নির্মিত হয়েছিলো গত বছর দুর্গা পূজার সময়। পূজার উদ্দেশ্যে প্রতিমা ম-পে আসার পর ঘটনাটি রেল কর্তৃপক্ষের নজরে আসে।
পূজার পরে ওই অস্থায়ী মন্দির বা ম-প সরিয়ে নিবে সংগঠকেরা, এই শর্তে কর্তৃপক্ষ তাদের ওই রেলের জায়গায় গত বছর পূজার অনুমতি দেয়। রেল কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে অনুরোধ আসার পরেও কিন্তু হিন্দু সংগঠকেরা পূজার পর ওই অস্থায়ী মন্দির সরায়নি। উল্টে কয়েকদিন আগে অস্থায়ী টিন-বাঁশের স্থাপনা সরিয়ে ইঁট-সিমেন্টের পাকা গাঁথুনি দিয়ে মন্দিরটি স্থায়ীভাবে তৈরীর কাজ শুরু করে। স্থায়ী স্থাপনার কাজ শুরু হতেই স্থানীয় মানুষজন তার প্রতিবাদ করে এবং তারপর রেল কর্তৃপক্ষ হিন্দু সংগঠকদের রেলের জমির বাইরে অন্য জায়গায় সরিয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য করে। মন্দিরের মূর্তিসব সরিয়ে নেয়ার পর কর্তৃপক্ষ ওই অবৈধ স্থাপনা ভেঙে দেয় বৃহস্পতিবার।
উল্লেখ্য,অবৈধ মন্দিরটি ভাঙার আগে রেলের জমির উপর অবৈধভাবে তৈরী দেড়শোরও বেশী দোকান, অন্যান্য স্থাপনা, এমনকি রাজনৈতিক দলের অফিসও ভেঙে দেয়া হয় সেদিন। এই ঘটনা ভারতীয় মিডিয়াতে ভুল তথ্যসহ অপেশাদারী স্টাইলে উপস্থাপনা করা হয়েছে। কেউ হাইলাইটই করেনি যে মন্দিরটি অবৈধভাবে রেলের জমির উপর তৈরী হয়েছিলো। ভারতের মিডিয়াতে এমনভাবে রিপোর্ট উপস্থাপনা করেছে তারা যে তাতে মনে হচ্ছে একটি বৈধ হিন্দু মন্দির ভেঙে দিয়েছে এক হিন্দুবিরোধী সরকার।
উল্লেখ্য যে, দখলের জন্য ‘ধর্মীয় স্থাপনা’ ব্যবহার একটি পুরনো ফর্মুলা। এখানে ধর্ম নয়, বরং উদ্দেশ্য ছিল ভূমি নিয়ন্ত্রণ। ফলে সরকার যখন সরকারী জমি থেকে উচ্ছেদ করে, তখন সেটি আইনগতভাবে সঠিক প্রশাসনিক পদক্ষেপ মাত্র। কোনো নির্দিষ্ট ধর্মের উপর মোটেই আঘাত নয়।
কিন্তু এখন ভারতীয় কিছু মিডিয়া ও দেশীয় অসৎ গোষ্ঠী এটিকে “ধর্মীয় নিপীড়ন” হিসেবে প্রচার করছে। অথচ ভারতে মসজিদ উচ্ছেদ এখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সেটা নিয়ে বেহায়া মিডিয়া কিংবা কেউ মুখ খোলে না।
হাতিরঝিল ছিল একটি উদাহরণ, যেখানে ধর্ম নয়, উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়েছে মুসলমানরা। কেউ জ্বালাও-পোড়াও করেনি, উল্টো রাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেছে। অথচ আজ, উচ্ছেদ ঠেকাতে মন্দির ‘পাকা’ করার চেষ্টা এবং পরে আন্তর্জাতিক মিডিয়া দিয়ে অপপ্রচার এটা কেবল ধর্ম নয়, কৌশলী দখলবাজির নগ্ন রাজনীতি।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ২০০৮ সালে মোদী যখন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী তখন রাজ্যের রাজধানী গান্ধীনগরে আশিটা হিন্দু মন্দির সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ভেঙে দেয়া হয় বেআইনী স্থাপনার বিরুদ্ধে সরকারী অভিযানের সময়। ২০১৫ সালে রাজস্থানে প্রায় একশোটি মন্দির ভেঙে দেয় স্থানীয় সরকার মেট্রো রেল তৈরী ও রাস্তা সম্প্রসারণের সময়। গত বছর বিজেপি জোট শাসিত মহারাষ্ট্রে একটি এলাকায় ৩০ টি বেআইনী হিন্দু মন্দির ভাঙার আদেশ দেয়। আর, মুসলমানদের মসজিদ, দরগা ও মাদ্রাসা ভেঙে দেয়ার উদাহরণ তো ভুরি ভুরি দেয়া যায়। অথচ ভারত ভুল তথ্যের মাধ্যমে দেখাতে চায় যে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের উপর জুলুম চলছে, তাদের স্বাধীনভাবে ধর্ম পালনে বাধা দেয়া হচ্ছে।
আসুন ধর্ম নিয়ে নয়, ভূমি আইন নিয়ে কথা হোক। উন্নয়ন নিয়ে বিতর্ক নয়, কৌশলী দখলবাজি রুখতে সাহস হোক। বাংলাদেশে ধর্ম আছে, সহনশীলতাও আছে কিন্তু আইনের শাসনকেও থাকতে হবে। সকল পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও ফ্রি-ল্যান্স কলামিস্ট।মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, ইমেইলঃ seraj.pramanik@gmail.com