রবিবার, ১০ নভেম্বর ২০২৪, ০৫:৪১ পূর্বাহ্ন
এ্যাডভোেেকট সিরাজ প্রামাণিক:
শিক্ষা জীবনের শুরু থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত অসাধারণ অনেক ভালো শিক্ষকের ছাত্র হতে পেরেছি। কিন্তু যদি সবচেয়ে প্রিয় শিক্ষক সম্পর্কে বলতে হয় তাহলে একজন শিক্ষকের কথাই আমি বলব। যিনি আমার এই ক্ষুদ্র জীবনের চলার পথে সবচেয়ে বেশি প্রেরণা ও উৎসাহ জুগিয়েছেন, তিনি আমার হিরন্ময় স্যার। সব কিছুকে ছাপিয়ে মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। এ অঞ্চলের হাজারো শিক্ষকেরও শিক্ষক তিনি। পরম মমতা আর আন্তরিক স্নেহ দিয়ে খোকসা অঞ্চলে তিনি তৈরি করেছেন হাজার হাজার শিক্ষার্থী, যারা আজ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত।
স্যার ছিলেন খোকসা জানিপুর বহুমুখী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। স্যার আমাদের বাংলা ব্যাকরণ পড়াতেন। স্কুলে বাংলা ব্যাকরণ খুবই কঠিন একটি বিষয় মনে হতো। আমার এই ব্যাকরণ ভীতি দূর হয় হিরন্ময় স্যারের পাঠদানের কারণেই। ক্লাসের পুরোটা সময় তিনি জ্ঞানের আলোয় মাতিয়ে রাখতেন ছাত্রদের। স্যারের পাঠদান এবং সুচিন্তিত আলোচনা সাহিত্যের প্রতি আমার প্রচ- আগ্রহ জেগে ওঠে। তখন থেকেই আমি বই পড়া, লেখালেখি শুরু করি, যার পরিবর্তে আমার ব্যক্তিগত চিন্তাধারা ও চিন্তাভাবনায় অনেক পরিবর্তন আনে। আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি কারণ এ প্রিয় শিক্ষকের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। স্যারকে খোকসার ‘পদ্মা সুইট হোটেল’ থেকে নিয়মিত খাবার এনে খেদমত করার সুযোগও আমার হয়েছিল। একদিন দেয়াল পত্রিকায় আমি স্টেশন বানান মূর্ধন্য ষ দিয়ে লিখেছিলাম। তিনি বললেন, ইংরেজি এস-এর বাংলা হবে দন্ত্য স। বিদেশি শব্দে ষ বসবে না। যা জীবন চলার পথে আজও পাথেয় হয়ে রয়েছে। স্যারের অনুপ্রেরণাতেই বাংলা সাহিত্যের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ি। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্স, মাষ্টার্স করার মধ্যে দিয়ে এ আসক্তির সমাপ্তি ঘটে।
গুরুজনে কর নতি, কোন কারকে কোন বিভক্তি? তিন ফলের সমাহার- ত্রিফলা কেন দ্বিগু সমাস? দম্পতির ব্যসবাক্য কিংবা এটা কোন সমাস? এমন হাজার বিষয়ের সমাধান দিতেন আমাদের হিরন্ময় স্যার। তিনি ছিলেন একটি জীবন্ত ব্যাকরণ বই।
বাংলা বাগধারা-বাগবিধি নিয়ে সেসময় আমি মজার একটি গল্প বানিয়েছিলাম। যা স্যারকে শুনালে খুব মজা পেতেন এবং আমাকে বাহবা দিতেন। গল্পটি এরকম যে, আক্কেল গুড়ুম= হতবুদ্ধি, অনুরোধে ঢেঁকি গেলা= অনুরোধে দুরূহ কাজ সম্পন্ন করতে সম্মতি দেয়া। আঙুল ফুলে কলাগাছ= হঠাৎ বড়লোক হওয়া। এসব বাগধারা তৈরিতে আমার সবসময়ই অষ্টরম্ভা ছিল। বাংলা ব্যাকরণের সঙ্গে আমার আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। এ জন্য হিরন্ময় স্যারের কাছে মাঝে মাঝেই আমি অর্ধচন্দ্র খেতাম। ব্যাকরণ ক্লাসের সময় স্যার ঘোড়ার ঘাস কাটা আর আষাঢ়ে গল্প শুনাতেন। এসব প্রতিবাদ করায় স্যার আমাকে অকালপক্ক বলে ডাকতেন। বলতেন, তুই যদি বাংলাতেও খারাপ ফলাফল করবি তাহলে তোর জন্য বাংলা ভাষা ইঁদুর কপালে। স্যারের সঙ্গে আমার অহিনকুল সম্পর্কে নেই। তারপরও স্যার আমাকে ইলশে গুঁড়ির ভেতরেই ক্লাস থেকে বের করে দিতেন। এই নিয়ে আমি কখনও উভয় সংকটে দেখিনি। আমি গদাই লস্করি চালে বের হয়ে যেতাম। আমার চিন্তা হলো- সমস্ত পড়ালেখার ভেতর ব্যাকরণ পড়া হলো কাঁঠালের আমসত্ত্ব। তার চেয়ে ভালো যদি কেউ এক বালতি তিতকুটে করলার জুস গিলে খাইয়ে দিত! দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় বাগধারা এলো- পটল তোলা। আমি ভেবেচিন্তে বানিয়ে কী কী সব লিখলাম। আমার ‘পটল তোলা’ বাগধারা চোখে পড়তেই স্যার হেসে গড়াগড়ি অবস্থা। ছাত্রদের কাছে গল্প বলা শুরু করলেন, এই অকাল কুষ্ফ্মান্ডটা কিছু না বুঝেই যা লিখেছে সেটাও অযৌক্তিক কারণে তাকে নম্বর দেওয়া থেকে বঞ্চিত করা যায় না। সে লিখেছে, পটল তোলা= মারা যাওয়া। লোকটি পটল ক্ষেতে পটল তুলতে তুলতে মারা গেল…।
অনেক বেশী বুঝি লিখে ফেললাম। এবার কিছু তিতে কথা দিয়ে লেখাটি শেষ করব। স্যার চোখে কম দেখতেন। সেকারণ, স্যারকে বাদ দিয়ে অন্য শিক্ষক নিয়োগের রাজনৈতিক পায়তারাও আমার দেখা, বুঝার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু গুড়ে বালি হয়েছে। আমরা স্যারকে শেষ জীবনে উপযুক্ত সন্মান দেখাতে পারেনি। ব্যর্থতার দায়ভার কাধে তুলে নিলাম। আমি কুষ্টিয়ার দহকুলা গ্রামে একাধিকবার স্যারকে দেখতে গিয়েছি। পরিবারের অনাদর আর অবহেলায় ভাল নেই স্যার। অনেক অভিযোগ শুনেছি। অন্য কেউ হলে আমার ক্ষুদ্র ক্ষমতায় শাস্তি নিশ্চিত করতাম। কিন্তু কবি ওখানেই নিরব। স্যার ভাল থাকবেন। আপনার জন্য অপেক্ষা করছে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সম্মানীত স্থান।
লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী, আইন বিশ্লেষক, আইনগ্রন্থ প্রণেতা ও সম্পাদক-প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। Email:seraj.pramanik@gmail.com মোবাইল: ০১৭১৬-৮৫৬৭২৮