রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ০৮:৪৪ অপরাহ্ন
এ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক:
চেক ডিসঅনার হলেই এখন আর সাজা নয়। প্রতিদানবিহীন হস্তান্তরযোগ্য দলিল বিষয়ে যখন পক্ষগণের মধ্যে যেখানে কোন প্রতিদান (কনসিডারেশন) থাকে না, সেখানে হস্তান্তরযোগ্য দলিল অকার্যকর হিসেবে গণ্য হবে। প্রতিদান ছাড়া যেমন চুক্তি হয় না, তেমনি প্রতিদান ছাড়া কোন হস্তান্তর যোগ্য দলিল কার্যকর করা যাবে না। কাজেই স্বাক্ষর সহ চেক কারও নিকট হস্তগত হলেই কিংবা ব্যাংক ডিসঅনার করলেই চেকের প্রতিদান বা দেনা পাওনা বা লেনদেন প্রমাণ করতে না পারলে মামলায় আসামী খালাস পাবে-এমনটিই বলেছেন উচ্চ আদালত। (লোকমান বনাম আয়ুব আলী এবং রাষ্ট্র মামলা, যা ৩৮ বিএলডি, পৃষ্টা ৬১৬,৬১৭-৬২০)।
মামলায় ঘটনায় প্রকাশ এই যে, বাদী কুমিল্লার সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আসামীর বিরুদ্ধে এই মর্মে নালিশী মামলা দাখিল করেন যে, আসামী বাদীর নিকট থেকে ঋণ হিসেবে ৪০ লক্ষ টাকা গ্রহণ করার পর উক্ত ঋণ পরিশোধের নিমিত্তে উক্ত পরিমাণ টাকা সম্বলিত একটি চেক বাদীর অনুকূলে ইস্যু করেন। উক্ত চেক নগদায়নের জন্য ব্যাংকে জমা দিলে ‘সিগনেচার ডিফারস’ অর্থাৎ চেকের স্বাক্ষরে মিল নেই মন্তব্যসহ ডিসঅনার হয়। এরপর বাদী আসামী বরাবর একটি লিগ্যাল নোটিশ প্রেরণ করেন। আসামী উক্ত লিগ্যাল নোটিশ প্রাপ্ত হলেও বাদীর অনুকূলে টাকা পরিশোধের কোন উদ্যোগ গ্রহণ করে নাই। নালিশটি দায়েরের পর আসামী সমন প্রাপ্ত হয়ে জামিন হলে মামলাটি বিচারের জন্য কুমিল্লার অতিরিক্ত দায়রা জজ, ৪র্থ আদালতে আসলে আদালত উভয় পক্ষের সাক্ষ্য প্রমাণাদি নিয়ে আসামীকে এ মামলার দায় থেকে খালাস দেন। আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন যে, আসামী সাফাই সাক্ষ্যর মাধ্যমে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে, বাদীর সাথে তার বৈধ কোন লেনদেন বা চেক সম্পর্কিত কোন কনসিডারেশন ছিল না। এরপর বাদী উক্ত রায়ের প্রতি সংক্ষুব্ধ হয়ে মাননীয় হাইকোর্টে যান। আদালত সেখানেও নি¤œ আদালতের আদেশ বহাল রাখেন। এভাবে সর্বোচ্চ আদালত আপিল বিভাগও আদেশ বহাল রাখেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় অধিকাংশ আইনজীবীর ৩৪২ ধারা আসামী পরীক্ষা সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা নেই।
অনেক আদালতও সঠিভাবে ৩৪২ ধারায় আসামী পরীক্ষা করেন না। এটাকে শুধুমাত্র ফরমালিটি মনে করে। এজন্য ৩৪২ ধারা অনুযায়ী আসামীকে পরীক্ষার সময় শুধুমাত্র জিজ্ঞাসা করে আসামী নির্দোষ দাবী করে কিনা এবং সাফাই সাক্ষী দেবে কি-না। এটা আদৌও আইন সম্মত নয়। হতাশ হতে হয় যখন অপীল আদালত আপীল শুনানীর সময় বলেন, আপনার দাবী, ঘটনার সময়, কি পরিস্থিতিতে তাকে মিথ্য মামলায় জড়িত করা হয়েছে, চেক সম্পর্কিত বিষয় কোনরুপ কনসিডারেশন ছিল না তার ব্যাখ্যা ৩৪২ ধারার বিবৃতিতে নেই, তাহলে কিভাবে আসামীকে খালাস দেয়া যাবে। ৩৪২ ধারা আসামী পরীক্ষা বিবৃতির উপর ভিত্তি করে মামলা খালাস কিংবা সাজা কমানোর অনেক নজির আছে সুপ্রিম কোর্টের বিভিন্ন মামলার রায়ে। হাসান আলী বনাম রাষ্ট, এই মামলায় এ্যাপিলেট ডিভিশন শুধুমাত্র ৩৪২ ধারায় আসামীর বয়স ৯০ বছর উল্লেখ থাকায় তার সাজা মানবিক দিকে বিবেচনা করে যতদিন হাজতে ছিল তত দিন করে দিয়েছে। হাসান আলী বনাম রাষ্ট্র, ১৫ বিএলডি (এডি) পৃষ্টা-৩৭।
অপর এক মামলায় মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসামীকে দঃ বিঃ ৪২০ ধারায় দন্ডাদেশ দিলে আসামী সেই দন্ডাদেশের বিরুদ্ধে দায়রা জজ আদালতে আপীল দায়ের করলে আপীল আদালত তাকে খালাস দেয়। উক্ত খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে বাদী মহামান্য হাইকোর্ট আপীল দায়ের করে। আপীল শুনানী শেষে মহামান্য হইকোর্ট ডিভিশন আপীল না-মঞ্জুর করেন এবং দায়রা জজ আদালতের রায় বহাল রখেন। মহামান্য হাইকোর্ট ডিভিশন রায়ে উল্লেখ করেন, দায়রা আপীল আদালত ৩৪২ ধারায় আসামীর সাফাই সাক্ষী যেখানে আসামী তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ও সাক্ষ্যের ব্যাখ্যা দিয়েছে তা বিবেচনায় নিয়ে খালাস দিয়ে কোন ভুল করেনি। ঐ রায়ে আরো উল্লেখ করা হয়েছে যে, ৩৪২ ধারার পরীক্ষা শুধুমাত্র আসামী এবং আসামীর উপকারের জন্য। (আব্দুল করিম বনাম শাসসুল ইসলাম ৪৫ ডিএলআর পৃষ্টা-৫৭৮)।
লেখকঃ বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগবেষক ও সম্পাদক প্রকাশক ‘দৈনিক ইন্টারন্যাশনাল’। মোবাইলঃ ০১৭১৬৮৫৬৭২৮, ই-মেইলঃseraj.pramanik@gmail.com